হস্তী বাহিনীর ঘটনাঃ কোরআন - হাদীসের ঘটনা

হস্তী বাহিনীর ঘটনাঃ

দ্বিতীয় ঘটনার সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে, আবরাহা সাবাহ হাবশী (তিনি নাজ্জাশী সম্রাট হাবশের পক্ষ হতে ইয়ামানের গভর্ণর ছিলেন) যখন দেখলেন যে, আরববাসীগণ ক্বাবা’হ গৃহে হজ্জব্রত পালন করছেন এবং একই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন সেখানে আগমন করছেন তখন সানআয় তিনি একটি বিরাট গীর্জা নির্মাণ করলেন এবং আরববাসীগণের হজ্জব্রতকে সেদিকে ফিরিয়ে আনার জন্য আহবান জানালেন। কিন্তু বনু কিনানাহ গোত্রের লোকজন যখন এ সংবাদ অবগত হলেন তখন তাঁরা এক রাত্রে গোপনে গীর্জায় প্রবেশ করে তার সামনের দিকে মলের প্রলেপন দিয়ে একদম নোংরা করে ফেললেন। এ ঘটনায় আবরাহা ভয়ানক ক্রোধান্বিত হন এবং প্রতিশোধ গ্রহণ কল্পে ক্বাবা’হ গৃহ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ষাট হাজার অস্ত্র সজ্জিত সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীসহ মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হন। তিনি নিজে একটি শক্তিশালী হস্তীপৃষ্ঠে আরোহণ করেন। সৈন্যদের নিকট মোট নয়টি অথবা তেরটি হস্তী ছিল।

আবরাহা ইয়ামান হতে অগ্রসর হয়ে মুগাম্মাস নামক স্থানে পৌঁছলেন এবং সেখানে তাঁর সৈন্যবাহিনীকে প্রস্তুত করে নিয়ে মক্কায় প্রবেশের জন্য অগ্রসর হলেন। তারপর যখন মুজদালেফা এবং মিনার মধ্যবর্তী স্থান ওয়াদিয়ে মুহাস্সারে পৌঁছলেন তখন তার হাতী মাটিতে বসে পড়ল। ক্বাবা’হ অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার জন্য কোন ক্রমেই তাকে উঠানো সম্ভব হল না। অথচ উত্তর, দক্ষিণ কিংবা পূর্ব মুখে যাওয়ার জন্য উঠানোর চেষ্টা করলে তা তৎক্ষণাৎ উঠে দৌঁড়াতে শুরু করত। এমন সময়ে আল্লাহ তা‘আলা এক ঝাঁক ছোট ছোট পাখী প্রেরণ করলেন। সেই পাখীগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে পাথরের ছোট ছোট টুকরো সৈন্যদের উপর নিক্ষেপ করতে লাগল। প্রত্যেকটি পাখি তিনটি করে পাথরের টুকরো বা কংকর নিয়ে আসত একটি ঠোঁটে এবং দুইটি দু’পায়ে। কংকরগুলোর আকার আয়তন ছিল ছোলার মতো। কিন্তু কংকরগুলো যার যে অঙ্গে লাগত সেই অঙ্গ ফেটে গিয়ে সেখান দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হতে হতে সে মরে যেত।

এ কাঁকর দ্বারা সকলেই যে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিল তা নয়। কিন্তু এ অলৌকিক ঘটনায় সকলেই ভীষণভাবে আতংকিত হয়ে পড়ল এবং প্রাণভয়ে পলায়নের উদ্দেশ্যে যখন বেপরোয়াভাবে ছুটাছুটি শুরু করল তখন পদতলে পিষ্ট হয়ে অনেকেই প্রাণত্যাগ করল। কংকরাঘাতে ছিন্নভিন্ন এবং পদতলে পিষ্ট হয়ে পলকে বীরপুরুষগণ মৃত্যুর কবলে ঢলে পড়তে লাগল। এদিকে আবরাহার উপর আল্লাহ তা‘আলা এমন এক মুসিবত প্রেরণ করলেন যে তাঁর আঙ্গুল সমূহের জোড় খুলে গেল এবং সানা নামক স্থানে যেতে না যেতেই তিনি পাখির বাচ্চার মতো হয়ে পড়লেন। তারপর তাঁর বক্ষ-বিদীর্ণ হয়ে হৃদপিন্ড বেরিয়ে এল এবং তিনি মৃত্যু মুখে পতিত হলেন।

মক্কা অভিমুখে আবরাহার অগ্রাভিযানের সংবাদ অবগত হয়ে মক্কাবাসীগণ প্রাণভয়ে নানা দিকে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পলায়ন করে পাহাড়ের আড়ালে কিংবা পর্বত চূড়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। তারপর যখন তাঁরা অবগত হলেন যে, আবরাহা এবং তাঁর বাহিনী সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে তখন তাঁরা স্বস্তির নিংশ্বাস ত্যাগ করে আপন আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন।[1]

অধিক সংখ্যক চরিতবেত্তাগণের অভিমত হচ্ছে এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্মলাভের মাত্র ৫০ কিংবা ৫৫ দিন পূর্বে মুহাররম মাস। অত্র প্রেক্ষিতে এটা ধরে নেয়া যায় যে ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল ৫৭১ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রেব্রুয়ারী মাসের শেষ ভাগে কিংবা মার্চ মাসের প্রথম ভাগে। হস্তী বাহিনীর এ ঘটনা ছিল আগামী দিনের নাবী (সাঃ) এবং ক্বাবা’হ শরীফের জন্য আল্লাহর সিদ্ধান্ত ও সাহায্যের এক সুস্পষ্ট নিদর্শন। এর পিছনে আরও যে একটি কারণ ছিল তা হচ্ছে নাবী কারীম (সাঃ) তাঁর আমলেই দেখলেন যে বায়তুল মুক্বাদ্দাস ছিল মুসলিমদের ক্বিবলাহহ এবং সেখানকার অধিবাসীগণও ছিল মুসলিম। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর উপর আল্লাহর শত্রুদের অর্থাৎ মুশরিকগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। এর সুস্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে বুখতুনাসসরের আক্রমণ (৫৮৭ খ্রীষ্ট পূর্ব অব্দে) এবং রোমানগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা (৭০ খ্রীষ্টাব্দে)। পক্ষান্তরে ক্বাবা’হর উপর খ্রীষ্টনদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় নি। যদিও তাঁরা তৎকালে মুসলিম ছিলেন এবং ক্বাবা’হর অধিবাসীগণ ছিলেন মুশরিক।

অধিকন্তু, এ ঘটনা এমন এক সময়ে সংঘটিত হয়েছিল যে, এ সংক্রান্ত সংবাদটি তৎকালীন সভ্য জগতের অধিকাংশ অঞ্চলে (রোমান সাম্রাজ্য, পারস্য সাম্রাজ্য ইত্যাদি) খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, হাবশী এবং রোমীয়গণের মধ্যে গভীর সম্প্রীতির সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। অপর দিকে পারস্যবাসীগণের দৃষ্টি রোমীয়গণের উপর সমভাবে নিপতিত ছিল এবং শেষ পর্যন্ত অবস্থা এ দাঁড়ায় যে, পারস্যবাসীগণ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ইয়ামান দখল করে বসে।

যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন রোমান এবং পারস্য এ দুইটি রাষ্ট্রই তৎকালীন পৃথিবীর উল্লে­খযোগ্য অংশের প্রতিনিধিত্ব করত এবং যেহেতু হস্তীবাহিনীর ঘটনাটি এ দু’রাষ্ট্রের সকলের নিকটেই সুবিদিত ছিল সেহেতু বলা যায় যে সমগ্র পৃথিবীর দৃষ্টি ক্বাবা’হ গৃহের অলৌকিকত্বের প্রতি নিবদ্ধ হয়ে গেল। বায়তুল্লাহর উচ্চ সম্মান ও সুমহান মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত সুস্পষ্ট নিদর্শন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার পর একথা তাঁদের মনে দৃঢ়ভাবে স্থান লাভ করল যে, এ গৃহকে সংরক্ষণ ও পবিত্রকরণ এবং এর সুমহান মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যাপারেই আল্লাহ তা‘আলা এ অলৌকিক ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন। অতএব ভবিষ্যতে এখানকার অধিবাসীগণের মধ্য থেকে কেউ যদি নবুয়ত দাবী করেন তবে সেই ঘটনার প্রেক্ষাপটে তা হবে আইন-সঙ্গত এবং বাঞ্ছনীয় ব্যাপার এবং তা হবে পার্থিব ব্যবস্থাপনার উর্ধ্বে খোদায়ী রাজত্বের ভিত্তি যা ঈমানদারদের সাহায্যার্থে অবতীর্ণ হয়েছিল গায়েবী সূত্র থেকে।

আব্দুল মুত্তালিবের ছিল সর্বমোট দশটি সন্তান। তাঁদের নাম ছিল যথাক্রমেঃ হারিস, জুবাইর, আবূ তালেব, আব্দুল্লাহ, হামজাহ, আবূ লাহাব, গায়দাক্ব, মুক্বাবভিম, যেরার, এবং ‘আব্বাস। কেউ কেউ বলেছেন যে তাঁর ছিল ১১টি সন্তান, একজনের নাম ছিল কুসাম। অন্য কেউ বলেছেন যে, ১৩টি সন্তান ছিল। অন্য দু’জনের নাম হল, ‘আব্দুল ক্বাবা’হ এবং ‘হাযল’। কিন্তু দশ জনের কথা যাঁরা বলেছেন তাঁরা বলেন যে, ‘মুক্বাবভিমেরই’ অপর নাম ছিল ‘আব্দুল ক্বাবা’হ এবং ‘গায়দাক্বেরর’ অপর নাম ছিল ‘হাযল’। তাঁদের মতে কুসাম নামে আব্দুল মুত্তালিবের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। আব্দুল মুত্তালিবের কন্যা ছিল ৬ জন। তাঁদের নামগুলো হচ্ছে যথাক্রমেঃ উম্মুল হাকীম (তাঁর অপর নাম বায়যা), বাররাহ, আতিকাহ, সাফিয়্যাহ, আরওয়া এবং উমাইয়া।[2]

[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৫৬ পৃঃ।

[2] তালকীহুল ফহুম ৮-৯ পৃঃ এবং রহমাতুল্লি­ল আলামীন ২য় খন্ড ৫৬-৬৬ পৃঃ।

Comments

|| Popular Posts ||

বিষয়__ জাহান্নামের স্তরসমূহ এবং শাস্তি _ গ্রন্থঃ জান্নাত-জাহান্নাম

Moving the finger during Tashahhud _ Important Masala-Masael,

Question:What is the correct explanation for the Prophet's saying: "The one who knows the most Qur'aan should lead the people in prayer…"? _ Fatwa collection

আল-ইতিছাম pdf download _ al itisham

The Prophet warns his kindred of idolatry....

The Story of Qarun(Korah)

টাখনুর নীচে কাপড় পরিধানের শাস্তি :

Why Allah sent Prophets and Messengers ? – Muhsin Khan & Hilaali