অধ্যায়ঃ মাওদু‘ হাদিস _ গ্রন্থঃ হাদিস শাস্ত্রের পরিভাষা পরিচিতি
Hadith Terminology:
وَالْكَذِبُ الْمُخْتَلَقُ الْمَصْنُوعُ | عَلى النَّبيْ فَذَلِكَ الْمَوْضُوعُ
“নবীর উপর সৃষ্ট ও বানোয়াট হাদিসই মিথ্যা এবং তাই মাওদু‘”। অত্র কবিতায় বর্ণিত ক্রমানুসারে হাদিসের দ্বাত্রিংশ প্রকার মাওদু‘।
লেখক রাহিমাহুল্লাহ কবিতার শুরুতে হাদিসের সর্বোত্তম প্রকার ‘সহি’র আলোচনা করেছেন, সর্বশেষ করেছেন নিকৃষ্ট প্রকার ‘মাওদু‘র আলোচনা। সহি ও মাওদু‘র মাঝে হাদিসের বিভিন্ন প্রকার উল্লেখ করেছেন।
موضوع কর্মবাচক বিশেষ্য وَضْع ক্রিয়া বিশেষ্য থেকে উদ্গত, অর্থ বানোয়াট, তৈরিকৃত ও নির্মিত। কবিতায় উল্লেখিত مختلق و مصنوع সামর্থবোধক শব্দ। ‘মাওদু’র আরেক অর্থ الشيء المحطوط অর্থাৎ জমিনে পতিত বস্তু।
‘মাওদু’র পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রসঙ্গে লেখক রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর বানোয়াট ও রচনাকৃত কথাই মাওদু”। রাবির ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর সকল রচনাকে মাওদু‘ বলা হয়।
মাওদু হাদিস বর্ণনাকারীগণ পাঁচ প্রকার:
ইব্নু জাওযি[1] রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “যেসব রাবিদের হাদিসে মাওদু‘, মিথ্যা ও মাকলুব প্রবেশ করেছে তারা পাঁচ প্রকার:
১. এক শ্রেণির মুহাদ্দিসের উপর বৈরাগ্য ও দুনিয়ার প্রতি অনীহা প্রবল ছিল, ফলে তারা যত্নসহ হাদিস মুখস্থ করেনি, মানুষের কথা ও হাদিস পৃথক করার বিদ্যা অর্জন করেনি। তাদের কারো কিতাব হারিয়ে গিয়েছিল, অথবা কোনো অগ্নি দুর্ঘটনায় পুড়ে গিয়েছিল, অথবা তারা নিজেদের কিতাবসমূহ মাটিতে দাফন করেছিল, অতঃপর মুখস্থ হাদিস বলে অনেক ভুল করেছেন। কখনো মুরসালকে মারফূ‘ ও মাওকুফকে মুসনাদ বর্ণনা করেছেন। কখনো সনদ পাল্টেছেন, কখনো এক হাদিসের সাথে অপর হাদিস একত্র করেছেন।
২. এক শ্রেণির মুহাদ্দিস ইলমে হাদিসের জন্য কষ্ট স্বীকার করেনি, ফলে তারাও ভুল করেছে, কখনো কঠিন ভুল করেছে।
৩. কতক সেকাহ মুহাদ্দিস শেষ বয়সে স্মৃতি শক্তি হ্রাসের কারণে হাদিসে ভুল করেছেন।
৪. এক শ্রেণির মুহাদ্দিস ছিল গাফেল ও সরলমনা। তারা কয়েক প্রকার: কেউ হাদিস শুনেই গ্রহণ করতেন, যদি বলা হত বলুন, তারা বলতেন। তাদের কতক সন্তান অথবা মুন্সি তাদেরকে হাদিস রচনা করে দিত, তারা নিজেদের অজান্তে তা বর্ণনা করতেন। কেউ শায়খের অনুমতি ব্যতীত তার হাদিস বর্ণনা করত, তার ধারণায় এরূপ করা বৈধ ছিল। জনৈক গাফিলকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: এটা কি তোমার শ্রবণকৃত খাতা? সে বলল: না, তবে যার শ্রবণকৃত সে মারা গেছে, আমি তার পরিবর্তে বর্ণনা করছি।
৫. এক শ্রেণির লোক ইচ্ছাকৃতভাবে হাদিস রচনা করেছে। তারা তিন প্রকার:
ক. কতক লোক প্রথম ভুল বর্ণনা করেছে, কিন্তু সঠিক হাদিস জানার পর মিথ্যার অপবাদ থেকে বাঁচার জন্য ভুল ত্যাগ করেনি।
খ. কতক লোক মিথ্যাবাদী ও দুর্বল রাবিদের নাম তাদলিস করে তাদের হাদিস বর্ণনা করেছে।
গ. কতক লোক জেনে-বুঝে মিথ্যা বলেছে, তারা ভুলে বলেনি, অপরের মিথ্যা হাদিসও বর্ণনা করেনি, বরং নিজেরা রচনা করেছে। তারা কখনো সনদে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে, কখনো অপরের হাদিস চুরি করেছে, কখনো নিজেরা জাল হাদিস রচনা করেছে।
হাদিস রচনার কারণ:
দীনের প্রতি বিদ্বেষ ও দ্বীনকে বিকৃত করার হীন উদ্দেশ্যে কেউ হাদিস রচনা করেছে। কেউ জাতি, ভাষা ও জাতীয়তাবাদের পক্ষে হাদিস রচনা করেছে। কেউ মতবাদ কিংবা মাযহাবের সমর্থনে হাদিস রচনা করেছে। কেউ ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য হাদিস রচনা করেছে। কেউ প্রসিদ্ধি পাওয়ার ইচ্ছায় হাদিস রচনা করেছে। কেউ সম্পদ অর্জন ও শাসকের নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে হাদিস রচনা করেছে। কেউ সুন্দর বাণীর জন্য সনদ তৈরি করে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সম্পৃক্ত করেছে।
ইব্ন হিব্বান রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “কতক লোক অল্প জ্ঞান ও শয়তানের প্ররোচনার কারণে কল্যাণের প্রতি আহ্বান ও পাপ থেকে বিরত রাখার নিমিত্তে মনগড়া ফযিলত ও শাস্তির হাদিস রচনা করে সেকাহ রাবিদের সনদে প্রচার করেছে। তিনি বলেন: আব্দুর রহমান ইব্ন মাহদি রাহিমাহুল্লাহ্ ‘মায়সারাহ[2] ইব্ন আব্দে রাব্বিহি’কে জিজ্ঞাসা করেন: ‘অমুক সূরা পাঠ করলে অমুক ফযিলত রয়েছে’। এ জাতীয় হাদিস তুমি কোথায় পেয়েছ? সে বলল: আমি মানুষদেরকে কুরআনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য এসব রচনা করেছি”।[3]
জাল হাদিস চেনার পদ্ধতি:
সনদ ও মতন উভয় থেকে জাল হাদিস চেনা যায়। সনদ থেকে জাল হাদিস চেনার একাধিক পদ্ধতি রয়েছে, যেমন খোদ হাদিস রচনাকারীর স্বীকারোক্তি; কোনো রাবির জন্ম ও তার শায়খের মৃত্যু ব্যবধান প্রমাণ করে তাদের সাক্ষাত অসম্ভব;[4] সনদে মিথ্যাবাদী রাবির উপস্থিতি; অথবা কোনো মুহাদ্দিস বলল যে, এ হাদিস অমুক মিথ্যাবাদী রাবি অমুক শায়খ থেকে একলা বর্ণনা করেছে, বিশেষ করে শায়খ যদি প্রসিদ্ধ ও তার ছাত্র সংখ্যা অনেক হয়, তাহলে এ ধারণা প্রবল হয়, কারণ অনেকের মাঝে সে একা সন্দেহের পাত্র।
মতন থেকে কয়েকভাবে জাল হাদিস জানা যায়। মতনে অনেক আলামত থাকে, যে কারণে সহজে বলা যায় যে, হাদিসটি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী নয়। ইব্ন দাকিকুল ঈদ রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: ‘হাদিস বিশারদগণ অনেক সময় শব্দ ও অর্থ দেখে জাল ও মাওদু‘ হাদিস নির্ণয় করেন।[5]
কখনো হাদিসের ভুল ও অবাস্তব অর্থ প্রমাণ করে হাদিসটি মাওদু‘। রাবি‘ ইব্ন খুসাইম রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন:
"إن للحديث ضوءا كضوء النهار، وظلمة كظلمة الليل تنكر"
“নিশ্চয় হাদিসের রয়েছে আলো, দিনের আলোর ন্যায়, আবার রয়েছে কিছু অন্ধকার, রাতের অন্ধকারের ন্যায়, যার মাধ্যমে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়”।[6]
ইব্ন জাওযি রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “তুমি চিন্তা করেছ কি, যদি একদল সেকাহ রাবি একত্র হয়ে বলে: উট সূচের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করেছে, তাহলে আমাদের কি ফায়দা হল? কারণ তারা অসম্ভব সংবাদ দিয়েছে। অতএব বিবেক বিরোধী অথবা কোনো স্বীকৃত নীতি বিরোধী হওয়া মাওদু‘ হাদিসের আলামত। সেটা গ্রহণ করার জন্য কষ্ট স্বীকার করা নিষ্প্রয়োজন”।[7]
কুরআন মাজিদ কিংবা মুতাওয়াতির হাদিস অথবা ইজমা বিরোধী হওয়া মাওদু‘ হাদিসের আলামত। অনুরূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের ঐতিহাসিক বাস্তবতার বিপরীত, সামান্য আমলে অধিক সাওয়াব ও ছোট পাপে কঠিন শাস্তির হুশিয়ারি সম্বলিত হাদিস মাওদু‘।
মিথ্যা ও মাওদু‘ হাদিস বলার বিধান:
হাফেয ইব্ন হাজার রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “নির্ভরযোগ্য সকল মুহাদ্দিসের মতে হাদিস রচনা করা হারাম। কাররামিয়া সম্প্রদায়ের কতক লোক ও একশ্রেণির সূফী আমলের প্রতি উৎসাহ দান ও পাপ থেকে সতর্ক করার জন্য হাদিস রচনা করা বৈধ বলেছে। এটা তাদের মূর্খতা, কারণ আমলের প্রতি উৎসাহ প্রদান ও পাপ থেকে সতর্ক করা শরয়ীতের বিধান, শরীয়তের বিধান তৈরি করা সবার নিকট কবিরা গুনাহ্। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
" مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا، فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ "
“যে আমার উপর মিথ্যা বলল, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়”।[8] মাওদু‘ হাদিস বর্ণনা করা হারাম। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَنْ حَدَّثَ عَنِّى، بِحَدِيثٍ يُرَى أَنَّهُ كَذِبٌ فَهُوَ أَحَدُ الْكَاذِبِينَ»
“যে আমার পক্ষ থেকে কোন হাদিস বর্ণনা করল, যা সে মিথ্যা মনে করছে, সেও একজন মিথ্যুক”।[9]
হাদিস রচনাকারীর তওবা গ্রহণযোগ্য নয়:
হাদিস রচনাকারীর তওবা গ্রহণযোগ্য নয় কয়েকটি কারণে, যেমন:
১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কেউ যেন মিথ্যা বলার সাহস না হয়, তবে তার তাওবা আল্লাহ ও তার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে।
২. মিথ্যা তওবা প্রকাশ করে কেউ যেন জাল হাদিস প্রচলন করার সুযোগ না পায়।
৩. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর মিথ্যা বলা অন্য কারো উপর মিথ্যা বলা সমান নয়, কারণ তার উপর মিথ্যা বলার অর্থ মানুষের জন্য দীন তৈরি করা, যার স্বপক্ষে আল্লাহ কোনো প্রমাণ নাযিল করেননি।
৪. জাল হাদিস রচনাকারী তওবার ক্ষেত্রেও মিথ্যা বলতে পারে, বিশেষ করে এতে যদি তার স্বার্থ থাকে। কেউ বলেছেন: তার তওবা শুদ্ধ হবে না, যদিও সে তওবা করে, কারণ তার জাল হাদিস মানুষের মাঝে ছড়িয়ে গেছে।
ইমাম নববি রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: ‘বিশুদ্ধ মতে তার তওবা গ্রহণযোগ্য ও তার হাদিস বর্ণনা করা দূরস্ত আছে, যেমন কাফের ব্যক্তির ইসলামের পর সাক্ষ্য গ্রহণ করা দুরস্ত আছে’।[10]
জাল হাদিসের উপর লিখিত কয়েকটি গ্রন্থ:
মাওদু হাদিসের সংখ্যা অনেক। অনেক আলেম এ বিষয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন, যেমন: ১. ‘আল-লাআলিল মাসনু‘আহ ফিল আহাদিসিল মাওদু‘আহ’। ২. ‘আল-ফাওয়েদুল মাজমু‘আহ ফিল আহাদিসিল মাওদু‘আহ’ লিশ শাওকানি। ৩. ‘আল-মাওদু‘আত’ লি ইব্নিল জাওযি।
> [1] আল-মাওদু‘আত: (১৫-১৭) [2] সে হাদিস রচনাকারী মিথ্যুক, কুরআনের ফযিলতের উপর একাধিক হাদিস রচনা করেছে সে। [3] ‘আল-মাজরূহিন’ লি ইব্ন হিব্বান: (১/৬৪) [4] যেমন কোনো রাবি বলল, আমাকে অমুক শায়খ বলেছেন, অতঃপর জানা গেল যে, শায়খের মৃত্যুর পর তার জন্ম। এখানে রাবি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। হয়তো সে মাধ্যম গোপন করেছে, কিংবা নিজে রচনা করেছে। এখানে রাবি স্বীকার করেনি, কিন্তু তার জন্ম তারিখ প্রমাণ করে হাদিসটি তার রচিত। [5] আল-ইকতিরাহ: (পৃ.২২৮) [6] আল-মুহাদ্দিসুল ফাসিল, (পৃ. ৩১৬); আন-নুকাত: (২/৮৪৪-৮৪৫), আল-কিফায়াহ: (পৃ.৬০৫) [7] আল-মাওদু‘আত। [8] মুসলিম: (৩) [9] মুসলিম। আন-নুযহাহ্: (পৃ.১২১-১২২) [10] মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থ: (১/৭০)
https://atowar-rahman-salafi.blogspot.com
Atowar Rahman Salafi
Comments
Post a Comment