জাল হাদীস / ইসলাম ধ্বংসে এক পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র --- - মাওলানা হাফেয মুহিউদ্দীন মুহাম্মাদ আনিছ

ভূমিকাঃ শরীয়তে ইসলামীর প্রধান ও প্রথম ভিত্তি হিসাবে আল-কুরআনুল কারীমের হিফাযত তথা সংরক্ষণের দায়িত্ব মহান আল্লাহ নিজেই নিয়েছেন। তিনি বলেন- “আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতরণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক।” (সূরা হিজর-৯)।

মূলতঃ এ আয়াতে কারীমা কুরআনুল কারীম হিফাযতের বিষয়ে আল্লাহ তায়ালার প থেকে একটি চূড়ান্ত আসমানী চ্যালেঞ্জ। আল্লাহ তায়ালার প থেকে কুরআন সংরণের এই শাশ্বত ঘোষণাতে আল-কুরআনের অবিনশ্বর সংরণ ও স্থায়িত্ব দান, তিলাওয়াত, পঠন, অর্থ ও মর্ম অনুধাবন এবং গবেষণা ও প্রচার-প্রসারের ধারাবাহিকতা চির অব্যাহত থাকার মহান সুসংবাদ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালার স্ব-বিশেষ ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে আল-কুরআন যেভাবে সম্পূর্ণরূপেই অক্ষুণ্ন এবং অপরিবর্তিতভাবে সংরতি হয়েছে আর কিয়ামত অবধি থাকবে, তেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের হাদীসকেও ধ্বংস ও বিলুপ্তির করাল গ্রাস থেকে রা করা হয়েছে এবং তা কিয়ামত পর্যন্তই থাকবে। হাদীস সংরণ ও সংকলনের সুদীর্ঘ ইতিহাস সর্বতোভাবে আলোচনা-পর্যালোচনা করলে এ কথাই সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে- হাদীসের জন্মলগ্ন থেকে গ্রন্থসমূহে গ্রন্থিত হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই এর হিফাযতের নিমিত্তে সর্বধরনের নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর হাদীস যাতে সর্বোৎকৃষ্টভাবে সংরতি থাকে এবং তাতে কোন প্রকার মিথ্যার আঁচ না লাগে- সে জন্যে কার্যকরী সমূহব্যবস্থা গ্রহণে কোন এক স্তরেও লেশমাত্র শিথিলতা প্রদর্শন করা হয়নি। কিন্তু এতদসত্ত্বেও হাদীসের এ বরকতময় দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় এমন একটি অবস্থা অবলোকন করা গিয়েছে, যখন খারাপ প্রকৃতির লোকেরা নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থসিদ্ধি অথবা অসৎ উদ্দেশ্যে স্বীয় কথাকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর হাদীস বলে চালিয়ে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে এবং তাদের মনগড়া এমন কতক কথামালা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর সুবিশাল হাদীস ভান্ডারে অনুপ্রবেশ ঘটেছে- এ কথা স্বীকার করতেই হবে।

জাল হাদীসের পরিচয়ঃ মূলতঃ জাল হাদীস রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর হাদীস নয়। এটি মানুষের মনগড়া কথা। তবুও কথা প্রসঙ্গে বলা হয়ে থাকে- ‘জাল হাদীস, ‘ভিত্তিহীন হাদীস’, ‘মিথ্যা হাদীস’। যেভাবে বলা হয়ে থাকে- ‘মিথ্যা নবী’। আর এ কথার উদ্দেশ্য হলো- সে নবীই নয়। ঠিক তেমনি জাল হাদীস, ভিত্তিহীন হাদীস এবং মিথ্যা হাদীসের অর্থ- এটি নবী কারীম (সা.)এর হাদীসই নয়। মুহাদ্দিসীনে কিরাম (রাহ.) একে ‘আল-মাওদূ’ নামে উল্লেখ করেছেন।

আভিধানিক অর্থ ‍ঃ ‘আল-মাওদূ’ আরবী শব্দ। মাসদার (ক্রিয়ামূল) ‘আল-ওয়াদ্য়ু’ থেকে গঠিত ইস্মে মাফ্য়ূল (কর্মবাচক বিশেষ্য)এর সীগাহ্ (শব্দরূপ)। অর্থ- তৈরি করা, সৃষ্টি করা, জন্ম দেওয়া, রচনা করা, বানানো ইত্যাদি। ‘লিসানুল আরব’ অভিধানে বলা হয়েছে- ‘এটি উঁচু-এর বিপরীতার্থক শব্দ।’ (৬/৪৫৩) মাওদূ অর্থ- প্রণীত, সৃষ্ট, রচিত, বানানো, নামানো হয়েছে এমন। সুতরাং, মাওদূ হাদীস অর্থ- যে হাদীসকে রচনা করা হয়েছে, বানানো হয়েছে অথবা যথাস্থান হতে নিচে নামিয়ে ফেলা হয়েছে।

পারিভাষিক অর্থঃ ইমাম হাফেয ওসমান ইব্নুস সালাহ (রাহ.) (৫৭৭-৬৪৩ হি.) এবং ইমাম হাফেয জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রাহ.) (৮৪৯-৯১১ হি.) বলেন- “মানবগড়া ও বানোয়াট হাদীসকে ‘মাওদূ’ বলা হয়।” (মুকাদ্দিমাতু ইব্নিস সালাহ-১২৯; তাদ্রীবুর রাবী-১/২০৫) ইমাম যায়্নুদ্দীন ইরাকী (রাহ.) (৭২৫-৮০৬ হি.)এর ভাষায়- “মিথ্যা, মনগড়া ও বানোয়াট হাদীসকে ‘মাওদূ’ বলা হয়।” (আত-তাব্সিরাহ্ ওয়াত তায্কিরাহ্-১/২৬১) আল্লামা যফর আহমাদ ওসমানী থানভী (রাহ.) (১৩১০-১৩৯৪ হি.) বলেন- “রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর নামে স্বেচ্ছায় মিথ্যা গড়া হয়েছে- এমন হাদীসকে ‘মাওদূ’ বলা হয়।” (কাওয়ায়িদ ফী উলূমিল হাদীস-৪২) আর ড. আবু বকর আবদুস সামাদ (রাহ.)এর ভাষায়- “নতুন করে বানানো মনগড়া যে বক্তব্যকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর হাদীস বলে মিথ্যা-মিথ্যি চালিয়ে দেওয়া হয়, তাকেই ‘মাওদূ’ বলা হয়।” (আল-ওয়াদ্য়ু ওয়াল ওয়াদ্দায়ূন-১০)।

উক্ত সংজ্ঞাসমূহে মাওদূ হাদীস যে প্রকৃতপে হাদীস নয়; বরং মানুষের মনগড়া কথা, তা গুরুত্বসহকারে বুঝানোর জন্যেই ‘মিথ্যা’, ‘মনগড়া’ ও ‘বানানো’ সমার্থবোধক শব্দত্রয় উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যথায় সংজ্ঞায় এর যে কোন একটি শব্দ ব্যবহার করলেই হয়ে যেত। উপরোল্লিখিত সংজ্ঞাগুলো দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে- রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর নামে স্বেচ্ছায় বানানো সব মিথ্যা কথা বা বাণীকে ‘আল-হাদীসুল মাওদূ’ তথা ‘জাল হাদীস’ বলে।

জাল হাদীসের সূচনাকালঃ জাল হাদীসের সূচনাকাল নির্ণয়ে মুহাদ্দিসীনে কিরাম (রাহ.)এর মধ্যে মতভেদ পরিলতি হয়। তবে গ্রহণযোগ্য অভিমত হলো- হিজরী প্রথম শতাব্দীর ৪০ (চল্লিশ) তম সালটি ছিল জাল হাদীস রচনার সূচনাকাল। অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর সোনালী যুগ থেকে হিজরী ৪০ সালের পূর্বণ অবধি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর হাদীসসমূহ সর্বধরনের মিথ্যা, বানোয়াট ও জালিয়াতি থেকে পবিত্র এবং সংরতি ছিল। ৩৫ হি./ ৬৫৬ ঈ. সনে তৃতীয় খলীফায়ে রাশেদ হযরত ওসমান ইব্নে আফ্ফান (রাযি.)এর মর্মান্তিক শাহাদাতবরণের মধ্য দিয়ে পুরো মুসলিম বিশ্বে ইখতিলাফ, মতানৈক্য ও মতভেদের এক অনতীতপূর্ব জড়োহাওয়া শুরু হয়। পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়তে লাগল বিভ্রান্তির সমূহ জাল। কালের এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মুসলিম জাতির মধ্যে ক্রমাগতভাবে কাদা ছুড়াছুড়ি ও দলগত মতবাদ শুরু হয়ে গেল। আর শেষ পর্যন্ত মুসলিম জাতি তিন দলে বিভক্ত হয়ে পড়লো। তাদের একদল হযরত আলী ইব্নে আলী তালিব (রাযি.)এর পে গিয়ে হযরত মুয়াবিয়া (রাযি.)এর বিরোধিতা করতে লাগল। এ দলকে ‘শীয়া’ বা ‘রাফিযী’ বলা হয়। আরেক দল হযরত মুয়াবিয়া (রাযি.)এর পাবলম্বন করতে গিয়ে হযরত আলী (রাযি.)এর বিরোধিতায় লিপ্ত হল। এদেরকে ‘নাসিবী’ বলা হয়ে থাকে। আর তৃতীয় দল হযরত আলী (রাযি.) ও হযরত মুয়াবিয়া (রাযি.) উভয়ের বিরোধিতা করে এবং তাঁদেরকে পথভ্রষ্ট মনে করেই বসল। এ দলকে ‘খারিজী’ নামে নামকরণ করা হয়।

উপরোক্ত দলত্রয়ে এমন কিছু লোক ছিল, যারা স্বীয় দল বা মতবাদকে শক্তিশালীকরণ ও প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে এবং বিরোধীপকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে কুরআন-হাদীস থেকে এ সবের দলীল-প্রমাণ খুঁজতে শুরু করল। যেখানেই তাদের মনঃপূত দলীল পাওয়া যেত না, সেখানেই তারা কুরআনের অপব্যাখ্যা বা তাফসীর বিকৃতির আশ্রয় গ্রহণ করত। সাথে সাথে তারা তাদের খারাপ উদ্দেশ্য পূরণার্থে নবী কারীম (সা.)এর নামে মিথ্যা ও জাল হাদীস রচনা, বর্ণনা ও প্রচার-প্রসার করতেও দ্বিধাবোধ করত না। এভাবেই কালচক্রে মানবসমাজে মিথ্যা বা জাল হাদীস রচনা ও বর্ণনার হিড়িক পড়ে যায়। (ইসলাম মে সুন্নাত ওয়া হাদীস কা মাকাম-১/১৫৯)।

হাদীস জালকরণের কারণসমূহঃ জাল হাদীস রচনা বা বর্ণনা করা একটি জঘন্যতম অপরাধ ও মহাপাপ। এ জঘন্য কাজটি যে সকল লোক করে কিংবা এর প্রতি যাদেরই প্ররোচনা ও উৎসাহ রয়েছে, তাদের জীবন যাপনের বিভিন্ন দিক নিয়ে পর্যালোচনা করলে এ ঘৃণিত মহাপাপটির আড়ালে অনেক কারণ রয়েছে বলে জানা যায়। ইমাম আবু আবদিল্লাহ্ মুহাম্মাদ ইব্নে আলী শাও্কানী ইয়ামানী (রাহ.) (মৃ. ১২৫০ হি.) তাঁর রচিত ‘আল-ফাওয়াইদুল মাজ্মূয়াহ্ ফিল আহাদীসিল মাওদূয়াহ্’ গ্রন্থের ৩৬৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন যে- ইতিহাসবেত্তা ওলামায়ে কিরাম (রাহ.) হাদীস জালকরণের ১১টি কারণ বর্ণনা করেছেন। আর আল্লামা ড. মুস্তফা সিবায়ী (রাহ.) তাঁর অনবদ্য সংকলনকর্ম ‘আস-সুন্নাতু ওয়া মাকানাতুহা ফিত-তাশরিয়িল ইসলামী’-এ জাল হাদীস রচনার সাতটি মৌলিক কারণ উল্লেখ করেছেন। যথা-

০১. রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি;

০২. ধর্মদ্রোহিতা;

০৩. সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি;

০৪. কিচ্ছা-কাহিনী ও ওয়ায;

০৫. পারস্পরিক মতানৈক্য;

০৬. তারগীব ও তারহীব, অর্থাৎ, অনেক আবেদ-যাহেদ ব্যক্তি মানুষকে দ্বীনের প্রতি অনুরক্ত করার মানসে ও সাওয়াবের প্রত্যাশায় এবং ধর্মীয় বিষয়াদিতে ভয়-ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে এবং

০৭. চাটুকারিতা, তথা রাজা-বাদশাহ্, আমীর-উমারার কথা বা কর্মের অনুকূলে হাদীস বর্ণনা করে তাদের নৈকট্য লাভ। (পৃ. ৭৮-৮৯)।

জাল হাদীস রচনার বিধানঃ রাসূলল্লাহ্ (সা.)এর নামে মিথ্যা বা জাল হাদীস রচনা একটি জঘন্য ও ঘৃণিত মহাপাপ- এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসীনে কিরাম একমত। কেননা, এটি এমন এক কবীরা গুনাহ্, যার সর্বশেষ ভয়াবহ পরিণাম হলো জাহান্নাম। সুতরাং, নবী কারীম (সা.)এর নামে সামান্যতম মিথ্যা কথাও রচনা করা কোন অবস্থাতেই জায়েয হবে না। কারণ, এর মাধ্যমে সর্বতোভাবে মাকামে নবুওয়াতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করারই সমতুল্য। (আল-ওয়াদ্য়ু ফিল হাদীস-১/৩১৭) তাইতো রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ইরশাদ করেছেন- “যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার উপর মিথ্যারোপ করবে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা খুঁজে নেয়।” (বুখারী, হাদীস-১১০; মুসলিম, হাদীস-৩০০৪; তিরমিযী, হাদীস-২৬৬৯) ইমাম ইবনুস সালাহ (রাহ.) বলেন- “এ হাদীসটি ‘সহীহ’ তথা বিশুদ্ধ এবং ‘মুতাওয়াতির’। কেননা, হাদীসটি সহীহাইন তথা ‘সহীহ বুখারী’ ও ‘সহীহ মুসলিম’-এ বর্ণিত হয়েছে। আর সাহাবায়ে কিরাম (রাযি.)এর বৃহত্তর অংশ এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম বায্যার (রাহ.) (২১৫-২৯২ হি.) তাঁর অমর হাদীস সংকলন ‘মুসনাদুল বায্যার’-এ উল্লেখ করেছেন যে, ‘রাসূলুল্লাহ্ (সা.) থেকে এ হাদীসটি চল্লিশজনের মতো পুরুষ সাহাবী (রাযি.) সরাসরি বর্ণনা করেছেন।’ আর কতক হাফেযুল হাদীস (রাহ.) বলেছেন- ‘বাষট্টিজন সাহাবায়ে কিরাম (রাযি.) রাসূলুল্লাহ্ (সা.) হতে হাদীসটি সরাসরি বর্ণনা করেছেন। এবং উক্ত সংখ্যায় আশারা মুবাশ্শারাহ্ বিল জান্নাহ্ (রাযি.) [ঐ দশজন সাহাবায়ে কিরাম (রাযি.), যাঁদেরকে দুনিয়াতে থাকাবস্থায়ই জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে]ও আছেন।’ সুতরাং, এ হাদীসের দু’টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে- ১. রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর হাদীসের সুবিশাল ভান্ডারে এটিই একমাত্র হাদীস, যাঁর বর্ণনাকারীগণের মধ্যে আশারা মুবাশ্শারাহ্ বিল জান্নাহ্ (রাযি.)এর সকলেই রয়েছেন। ২. এটিই একমাত্র হাদীস, যাঁকে ষাটের অধিক সাহাবায়ে কিরাম (রাযি.) সরাসরি রাসূলুল্লাহ্ (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ, অন্য কোন হাদীসের ক্ষেত্রে এ বৈশিষ্ট্যদ্বয় পাওয়া যায় না।” (মুকাদ্দিমাতু ইব্নিস সালাহ-২৪৯) ইমাম ইবনুল জাওযী (রাহ.) বলেন- “৯৮ (আটানব্বই) জন সাহাবায়ে কিরাম (রাযি.) নবী কারীম (সা.) থেকে এ হাদীসটি (সরাসরি) বর্ণনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে আশারা মুবাশ্শারাহ্ বিল জান্নাহ্ (রাযি.)এর সকলেই রয়েছেন। এ মহান বৈশিষ্ট্যদ্বয়ের অধিকারী শুধু উক্ত হাদীসই।” (ফায়্যুল কাদীর-৬/২৮৬)। অন্য হাদীসে আছে, “আমার উপর মিথ্যারোপ করা, অন্য কারো উপর মিথ্যারোপ করার মত নয়। যে আমার উপর মিথ্যারোপ করবে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়।” (বুখারী, হাদীস-১২৭৭; মুসলিম, হাদীস-৪) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- “যে ব্যক্তি আমার ব্যাপারে এমন কথা বলবে- যা আমি বলিনি, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়।” (বুখারী, হাদীস-১০৯)।

মিথ্যা হাদীস রচনার শাস্তিঃ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর নামে মিথ্যা বা জাল হাদীস রচনা যেহেতু একটি অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ, সেহেতু এর জন্যে পরকালে মারাত্মক ধরণের আযাব-শাস্তি, এমনকি চিরকালের জন্যে জাহান্নামের উত্তপ্ত আগুনে নিপ্তি হওয়া ছাড়াও ইহজগতে তার জন্যে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রাহ.) বলেন- “আমার জানা মতে আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ওলামা-মাশায়েখের কেউ কোন কবীরা গুনাহ্কারীকে কাফির বলে ফাত্ওয়া দেননি। কিন্তু নবী কারীম (সা.)এর নামে মিথ্যা বা জাল হাদীস রচনাকারীকে কাফির বলে ওলামায়ে কিরামের সহীহ ফাত্ওয়া রয়েছে। যেমন, শায়খ আবু মুহাম্মাদ জুওয়াইনী (রাহ.) নবী কারীম (সা.)এর নামে মিথ্যা বা জাল হাদীস রচনাকারীকে কাফির বলে অভিহিত করেছেন।” (তাদরীবুর রাবী-১/২৮৪; তাহযীরুল খাওয়াস-৬৪)।

খুলাফায়ে আব্বাসিয়ার কোন কোন শাসক নবী কারীম (সা.)এর নামে মিথ্যা হাদীস বানোয়াটকারী অনেক যিন্দীককে হত্যা করেছেন। যেমন- প্রসিদ্ধ হাদীস বানোয়াটকারী আবদুল কারীম ইবনে আবুল আওজা’কে তদানীন্তন বসরার শাসনকর্তা মুহাম্মাদ ইব্নে সুলায়মান রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর নামে মিথ্যা হাদীস গড়ার ঘৃণিত অপরাধে হত্যা করেন। (ইসলাম মে সুন্নাত ওয়া হাদীস কা মাকাম-১/১৭৮)

জাল হাদীস প্রতিরোধে মুহাদ্দিসগণের ভূমিকা ‍ঃ মুহাদ্দিস (হাদীসগবেষক)-গণ জাল (মিথ্যা) হাদীসসমূহকে সম্পূর্ণ পৃথক গ্রন্থে গ্রন্থিত করে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর হাদীসের বিশুদ্ধতা রা করেছেন। এজন্যে তাঁরা হাদীস বর্ণনার সাথে সাথে রাবী অর্থাৎ বর্ণনাকারীগণের সার্বিক অবস্থা, তথা- সনদে উল্লেখিত প্রত্যেক রাবীর নাম-উপাধি, বংশ-পরিচয়, জন্মস্থান, জন্ম-মৃত্যুর সন ও তারীখ, [সাহাবী (রাযি.) হলে তিনি কোন্ সময়ে ইসলাম গ্রহণ করেছেন], তিনি কোন কোন ব্যক্তির কাছ থেকে হাদীস শ্রবণ করেছেন, তার নিকট থেকে কারা কারা হাদীস শ্রবণ করেছেন, হাদীস বর্ণনার েেত্র তার স্থান কোথায়, তার নৈতিক ও মানসিক অবস্থাদি কেমন ছিল, তার স্মৃতিশক্তি কিরূপ, শেষ বয়স পর্যন্ত তার স্মৃতিশক্তিতে কোনরূপ রদবদল হয়েছে কিনা, তিনি কিরূপ বোধশক্তির অধিকারী, তার নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা কতটুকু, তার আচার-আচরণ কেমন, তিনি বিশুদ্ধ আক্বীদার অধিকারী ছিলেন কিনা? তিনি কি বিদআতপন্থী ছিলেন? কোন্ পরিবেশে তিনি জীবন অতিবাহিত করেছেন? তার ব্যাপারে তার সমসাময়িক লোকদের ধারণা কি? তার সফর ও প্রস্থান এবং আল্লাহ্ভীরুতা ও আমানতদারী ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয়গুলো অতিসূক্ষ্মভাবে অনুসন্ধান করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে মুসলিমজাতির তত্ত্ব ও তথ্যের এক বিরাট চরিত-অভিধান। আর এটিই ‘ইল্মু আস্মাইর রিজাল’ (হাদীস বর্ণনাকারীগণের জীবনী শাস্ত্র) নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে তাঁরা (মুহাদ্দিসীনে কিরাম) ‘সহীহ’ ও ‘জাল’ হাদীসের তারতম্য শনাক্তের সাথে সাথে কুমতলবী ও স্বার্থান্বেষীদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মূলোৎপাটন করেছেন।

পরবর্তীতে হাদীস গবেষকগণ আসমাউর রিজাল শাস্ত্রের উপর সম্পূর্ণ পৃথকভাবে গ্রন্থাদি রচনা করে এ বিশাল শাস্ত্রকে অমর জীবন দান করেন। যেমন-

০১. ‘আল-কামাল ফী আস্মাইর রিজাল’ (১০ খন্ড) -ইমাম হাফেয আবদুল গনী মাক্দিসী (রাহ.) (মৃ. ৬০০ হি.);

০২. ‘তাহ্যীবুল কামাল ফী আস্মাইর রিজাল’ (১২ খ.) -ইমাম হাফেয ইউসুফ মিয্যী (রাহ.) (মৃ. ৭৪২ হি.);

০৩. ‘তায্কিরাতুল হুফ্ফায’ (৪ খ.) -ইমাম মুহাম্মাদ যাহাবী (রাহ.) (মৃ. ৭৪৮ হি.);

০৪. ‘মীযানুল ইতিদাল’ (৪ খ.) -ঐ;

০৫. ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’ (২৫ খ.) -ঐ;

০৬. ‘তাকরীবুত তাহযীব’ (২ খ.) -ইমাম হাফেয আহমাদ ইব্নে হাজার আস্কালানী (রাহ.) (মৃ. ৮৫২ হি.);

০৭. ‘তাহযীবুত তাহযীব’ (১২ খ.) -ঐ;

০৮. ‘লিসানুল মীযান’ (৮ খ.) -ঐ ইত্যাদি এ শাস্ত্রের প্রামাণ্য গ্রন্থাদি অন্যতম।

প্রখ্যাত জার্মান পন্ডিত প্রাচ্যবিদ ড. স্পৃংগার তার ‘আল-ইসাবাহ ফী আহওয়ালিস সাহাবা’ [হাফেয ইব্নে হাজার আস্কালানী (রাহ.) রচিত ‘আল-ইসাবাহ্ ফী তাময়ীযিস সাহাবা’ গ্রন্থের ইংরেজী সংস্করণের ভূমিকায় (কলিকাতায় মুদ্রিত- ১৮৫৩-৬৪ ঈসায়ী) আস্মাউর রিজাল শাস্ত্রের অমর ও অতুলনীয় কৃতিত্বের উপর আমাদের মনীষীবৃন্দের প্রশংসা করতে গিয়ে কতইনা চমৎকার লিখেছেন- `There is no nation, nor has there been any which like them has during twelve centuries recorded the life of every man of letters. If the biographical records of Musalman were collected, we should probably have accounts of the lives of half a million of distinguished persons.’ (আল-ইসাবাহ্ গ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদের ভূমিকা থেকে উদ্ধৃত) অর্থাৎ “পৃথিবীতে এমন কোন জাতি আবির্ভূত হয়নি কিংবা বর্তমানেও এমন কোন জাতি নেই, যারা মুসলিমদের ন্যায় সুদীর্ঘ বারো শতাব্দী পর্যন্ত প্রত্যেক জ্ঞানী-গুণীর জীবনালেখ্য লিপিবদ্ধ করে রাখতে সমর্থ হয়েছে। মুসলিমদের জীবন-চরিতগুলো সংগৃহীত হলে আমরা খুব সম্ভব ০৫ (পাঁচ) লক্ষ বিশিষ্ট ব্যক্তি (রাবী)এর জীবনেতিহাস সম্পর্কে অবহিত হতে পারতাম।” ড. স্প্রিংগার ১৮৫৬ ঈ. সনে এ মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। তারপরও রিজাল শাস্ত্রের উপর এ পর্যন্ত বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে।

জাল হাদীস সংগ্রহ এবং সেগুলোর উপর রচিত গ্রন্থাবলী ‍ঃ মুহাদ্দিসীনে কিরাম (রাহ.) কল্পনাতীত মেহনত-মুজাহাদার বিনিময়ে অনেক যাচাই-বাছাই করে যেহেতু সহীহ হাদীসসমূহ সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করেছেন, সেহেতু জাল হাদীসসমূহ সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করার আর কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু ‘আসল’ ও ‘নকল’- এ দু’ জিনিসকে পরিপূর্ণভাবে পৃথক করা এবং সর্বসাধারণকে নকল হাদীসের ধোঁকা ও প্রবঞ্চনা-প্রতারণা থেকে সর্বতোভাবে হিফাযত করার মানসে নকল তথা জাল হাদীসসমূহ সংগ্রহ করার পরও লিপিবদ্ধকরণের যুগান্তকারী পদপে গ্রহণ করেছেন। একে হাদীস জালকরণের প্রতিকারের সর্বশেষ ব্যবস্থা বলে অভিহিত করা যেতে পারে। নিম্নে জাল হাদীস সম্বলিত কিছু গ্রন্থ উল্লেখ করা হল-

০১. ‘তাযকিরাতুল মাওদূয়াত’- হাফেয মুহাম্মাদ ইব্নে তাহির মাক্দিসী (রাহ.) (মৃ. ৫০৭ হি.)। কিন্তু তিনি ‘ইব্নুল কায়্সারানী’নামেই প্রসিদ্ধ।

০২. ‘আল-মাওদূয়াত মিনাল আহাদীসিল মারফুয়াত’ -ইমাম হাফেয আল-হুসাইন জূযাকানী (রাহ.) (মৃ. ৫৪৩ হি.)। কিন্তু এটি ‘কিতাবুল আবাতীল’ নামেই খ্যাত।

০৩. ‘আল-মাওদূয়াত’ -ইমাম হাফেয ইব্নুল জাওযী (রাহ.) (মৃ. ৫৯৭ হি.)।

০৪. ‘আল-মুগনী’ -হাফেয ওমর ইব্নে বদ্র মাওসিলী হানাফী (রাহ.) (মৃ. ৬২২ হি.)।

০৫. ‘আদ-দুররুল মুলতাকাত ফী তাব্য়ীনিল গালাত’ -ইমাম সাগানী হানাফী (রাহ.) (মৃ. ৬৫০ হি.)। কিন্তু এটি ‘রিসালাতুল মাওদূয়াত’ নামেই প্রসিদ্ধ।

০৬. ‘আহাদীসুল কিসাস’ -ইমাম হাফেয আহমাদ তায়্মিয়া (রাহ.) (মৃ. ৭২৮ হি.)।

০৭. ‘আল-মানারুল মুনীফ’ -ইমাম হাফেয ইব্নে কাইয়িম জাওযিয়া (রাহ.) (মৃ. ৭৫১ হি.)।

০৮. ‘আল-লাআলিল মানসুরাহ্’ -ইমাম যারকাশী (রাহ.) (মৃ. ৭৯৪ হি.)।

০৯. ‘আল-বায়িসু আলিয়্যান’ -হাফেয যায়্নুদ্দীন ইরাকী (রাহ.) (মৃ. ৮০৬ হি.)।

১০. ‘আল-লাআলিল মানসুরাহ্’ -ইমাম হাফেয ইব্নে হাজার আস্কালানী (রাহ.) (মৃ. ৮৫২ হি.)।

১১. ‘আল-মাকাসিদুল হাসানাহ্’ -হাফেয সাখাবী (রাহ.) (মৃ. ৯০২ হি.)।

১২. ‘আল-লাআলিল মাসনুয়াহ্’ -ইমাম হাফেয জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রাহ.) (মৃ. ৯১১ হি.)।

১৩. ‘তাহযীরুল খাওয়াস’ -ঐ।

১৪. ‘আল-ফাওয়াইদুল মাজ্মূয়াহ্’ -হাফেয মুহাম্মাদ ইব্নে ইউসুফ শামী (রাহ.) (মৃ. ৯৪২ হি.)।

১৫. ‘তানযীহুশ শারীয়াতিল মারফূয়াহ্’ -হাফেয ইব্নে র্আরাক কিনানী (রাহ.) (মৃ. ৯৬৩ হি.)।

১৬. ‘তায্কিরাতুল মাওদূয়াত’ -আল্লামা মুহাম্মাদ ইব্নে তাহির সিদ্দীকী পাট্টনী (রাহ.) (মৃ. ৯৮৬ হি.)।

১৭. ‘আল-মাওদূয়াতুল কুবরা’ -শায়খ মুল্লা আলী ক্বারী হানাফী (রাহ.) (মৃ. ১০১৪ হি.)।

১৮. ‘আল-মাসনু’ -ঐ।

১৯. ‘কাশ্ফুল খিফা’ -শায়খ ইসমাঈল আজ্লূনী (রাহ.) (মৃ. ১১৬২ হি.)।

২০. ‘আদ-দুরারুল মাসনুয়াত’ -শায়খ মুহাম্মাদ সাফারীনী (রাহ.) (মৃ. ১১৮৮ হি.)।

২১. ‘আল-ফাওয়াইদুল মাজ্মূয়াহ্’ -ইমাম শাওকানী (রাহ.) (মৃ. ১২৫০ হি.)।

২২. ‘আসনাল মাতালিব’ -ইমাম মুহাম্মাদ ইব্নে দারবেশুল হূত বায়রুতী (রাহ.) (মৃ. ১২৭৬ হি.)।

২৩. ‘আল-আসারুল মারফুয়াহ্’ -আল্লামা আবদুল হাই লাখনভী (রাহ.) (মৃ. ১৩০৪ হি.)।

২৪. ‘সিল্সিলাতুল আহাদীসিদ দায়ীফা ওয়াল মাওদূয়াহ্’ -শায়খ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল্বানী (রাহ.)

২৫. ‘আল-ইসরাঈলিয়্যাত ওয়াল মাওদূয়াত’ -ড. মুহাম্মাদ আবু শাহবাহ্ (রাহ.) এবং

২৬. ‘প্রচলিত জাল হাদীসঃ একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ’ -মাওলানা মুহাম্মদ জাকারিয়া হাসনাবাদী।

তত্ত্বাবধানে- আল্লামা হাফেয মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী (দা.বা.)।

[উচ্চতর হাদীস গবেষণা বিভাগ, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী-এর বিষয় ভিত্তিক মাসিক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত প্রবন্ধ]

সত্যায়নে- আল্লামা হাফেয মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী, প্রখ্যাত মুহাদ্দিস- দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

Comments