গ্রন্থঃ বিদ‘আত পরিচিতির মূলনীতি

বিদ‘আতের সংজ্ঞা 

আল্লাহর নিকট ইসলামই হচ্ছে একমাত্র মনোনীত দীন। আল-কুরআনে তিনি বলেন,

﴿وَمَن يَبۡتَغِ غَيۡرَ ٱلۡإِسۡلَٰمِ دِينٗا فَلَن يُقۡبَلَ مِنۡهُ﴾ [ال عمران: ٨٥]

‘‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন অনুসন্ধান করে, তা কখনোই তার কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে না’’। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮৫]

এ দীনকে পরিপূর্ণ করার ঘোষণাও আল্লাহ আল-কুরআনে দিয়েছেন,

﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗا﴾ [المائ‍دة: ٣]

‘‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’’ [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৩]

এ ঘোষণার পর আল-কুরআন ও সুন্নাহ’র বাইরে দীনের মধ্যে নতুন কোনো বিষয় সংযোজিত হওয়ার পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেল এবং বিদ‘আত তথা নতুন যে কোনো বিষয় দীনী আমল ও আকীদা হিসেবে দীনের অন্তর্ভুক্ত হওয়াও হারাম হয়ে গেল। এ আলোচনায় বিদ‘আতের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরার পাশাপাশি কীভাবে আমাদের সমাজে প্রচলিত বিদ‘আতগুলোকে সনাক্ত করা যায় সে সম্পর্কিত মূলনীতি তুলে ধরা হবে।

বিদ‘আতের সংজ্ঞা:

বিদ‘আত শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো:

اَلشَّيْءُ الْمُخْتَرَعُ عَلٰى غَيْرِ مِثَالٍ سَابِقٍ

অর্থাৎ পূর্ববর্তী কোনো নমুনা ছাড়াই নতুন আবিষ্কৃত বিষয়।[1]

আর শরী‘আতের পরিভাষায়-

مَا أُحْدِثَ فِى دِيْنِ اللهِ وَلَيْسَ لَهُ أَصْلٌ عَامٌ وَلاَخَاصٌّ يَدُلُّ عَلَيْهِ

অর্থাৎ আল্লাহর দীনের মধ্যে নতুন করে যার প্রচলন করা হয়েছে এবং এর পক্ষে শরী‘আতের কোনো ব্যাপক ও সাধারণ কিংবা খাস ও সুনির্দিষ্ট দলীল নেই।[2]

এ সংজ্ঞাটিতে তিনটি বিষয় লক্ষণীয়:

১. নতুনভাবে প্রচলন অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে এর কোনো প্রচলন ছিল না এবং এর কোনো নমুনাও ছিল না।

২. এ নব প্রচলিত বিষয়টিকে দীনের মধ্যে সংযোজন করা এবং ধারণা করা যে, এটি দীনের অংশ।

৩. নব প্রচলিত এ বিষয়টি শরী‘আতের কোনো ‘আম বা খাস দলীল ছাড়াই চালু ও উদ্ভাবন করা।

সংজ্ঞার এ তিনটি বিষয়ের একত্রিত রূপ হল বিদ‘আত, যা থেকে বিরত থাকার কঠোর নির্দেশ শরী‘আতে এসেছে। কঠোর নিষেধাজ্ঞার এ বিষয়টি হাদীসে বারবার উচ্চারিত হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম বলেছেন,

«وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ».

‘‘তোমরা (দীনের) নব প্রচলিত বিষয়সমূহ থেকে সতর্ক থাক। কেননা প্রত্যেক নতুন বিষয় বিদআ‘ত এবং প্রত্যেক বিদ‘আত ভ্রষ্টতা’’।[3]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম তাঁর এক খুতবায় বলেছেন:

«إِنَّ أَصْدَقَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللهِ وَأَحْسَنَ الْهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الأُمُوْرِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ وَكُلُّ ضَلاَلَةٍ فِي النَّارِ».

‘‘নিশ্চয় সর্বোত্তম বাণী আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মদের আদর্শ। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হল (দীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। আর নব উদ্ভাবিত প্রত্যেক বিষয় বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আত হল ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।[4]

[1] আন-নিহায়াহ, পৃ. ৬৯; কাওয়ায়েদ মা‘রিফাতিল বিদ‘আহ, পৃ. ১৭ [2] কাওয়ায়েদ মা‘রিফাতিল বিদ‘আহ, পৃ. ২৪ [3] সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৯৯১; সুনান আত-তিরমিযী, হাদীস নং ২৬৭৬। তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান ও সহীহ বলেছেন। [4] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৫৩৫ ও সুনান আন-নাসাঈ, হাদীস নং ১৫৬০। হাদীসের শব্দ চয়ন নাসায়ী থেকে। 

বিদ‘আতের বৈশিষ্ট্য 

বিদ‘আতের চারটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে:

১. বিদ‘আতকে বিদ‘আত হিসেবে চেনার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো দলীল পাওয়া যায় না; তবে তা নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে মূলনীতিগত ‘আম ও সাধারণ দলীল পাওয়া যায়।

২. বিদ‘আত সবসময়ই শরী‘আতের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও মাকাসিদ এর বিপরীত ও বিরোধী অবস্থানে থাকে। আর এ বিষয়টিই বিদ‘আত নিকৃষ্ট ও বাতিল হওয়ার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এ জন্যই হাদীসে বিদ‘আতকে ভ্রষ্টতা বলে অভিহিত করা হয়েছে।

৩. অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদ‘আত এমন সব কার্যাবলী সম্পাদনের মাধ্যমে হয়ে থাকে যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে প্রচলিত ছিল না। ইমাম ইবনুল জাওযী রহ: বলেন,

البِدْعَةُ عِبارةٌ عَنْ فِعلٍ لَمْ يَكُنْ فابتُدِعَ

‘বিদ‘আত বলতে বুঝায় এমন কাজকে যা ছিল না, অতঃপর তা উদ্ভাবন করা হয়েছে’।[1]

৪. বিদ‘আতের সাথে শরী‘আতের কোনো কোনো ইবাদাতের কিছু মিল থাকে। দু’টো ব্যাপারে এ মিলগুলো লক্ষ্য করা যায়:

প্রথমত: দলীলের দিক থেকে এভাবে মিল রয়েছে যে, কোনো একটি ‘আম দলীল কিংবা সংশয় অথবা ধারণার ভিত্তিতে বিদ‘আতটি প্রচলিত হয় এবং খাস ও নির্দিষ্ট দলীলকে পাশ কাটিয়ে এ ‘আম দলীল কিংবা সংশয় অথবা ধারণাটিকে বিদ‘আতের সহীহ ও সঠিক দলীল বলে মনে করা হয়।দ্বিতীয়ত: শরী‘আত প্রণীত ইবাদাতের রূপরেখা ও পদ্ধতির সাথে বিদ‘আতের মিল তৈরী করা হয় সংখ্যা, আকার-আকৃতি, সময় বা স্থানের দিক থেকে কিংবা হুকুমের দিক থেকে। এ মিলগুলোর কারণে অনেকে একে বিদ‘আত মনে না করে ইবাদাত বলে গণ্য করে থাকেন।

> [1] তালবীসু ইবলীস, পৃ. ১৬  
বিদ‘আত নির্ধারণে মানুষ সাধারণতঃ তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত:

এক: দলীল পাওয়া যায় না এমন প্রতিটি বিষয়কে এক শ্রেণির মানুষ বিদ‘আত হিসেবে চিহ্নিত করছে এবং এক্ষেত্রে তারা বিশেষ বাছ-বিচার না করেই সব কিছুকে (এমন কি মু‘আমালার বিষয়কেও) বিদ‘আত বলে অভিহিত করছে। এদের কাছে বিদ‘আতের সীমানা বহুদূর বিস্তৃত।

দুই: যারা দীনের মধ্যে নব উদ্ভাবিত সকল বিষয়কে বিদ‘আত বলতে রাজী নয়; বরং বড় বড় নতুন কয়েকটিকে বিদ‘আত বলে বাকী সবকিছু শরী‘আতভুক্ত বলে তারা মনে করে। এদের কাছে বিদ‘আতের সীমানা খুবই ক্ষুদ্র।

তিন: যারা যাচাই-বাছাই করে শুধুমাত্র প্রকৃত বিদ‘আতকেই বিদ‘আত বলে অভিহিত করে থাকেন। এরা মধ্যম পন্থাবলম্বী এবং হকপন্থী।

Comments

|| Popular Posts ||

বিষয়__ জাহান্নামের স্তরসমূহ এবং শাস্তি _ গ্রন্থঃ জান্নাত-জাহান্নাম

Moving the finger during Tashahhud _ Important Masala-Masael,

Supplications after the Fard Salah (Obligatory Prayer) :

Hadith on Shukr: Take advantage of five blessings before deprived

The Prophet warns his kindred of idolatry....

ক্রুসেডের ইতিহাস : খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ

Hadith on Zina: Staring with lust is committing adultery.....

The Story of The Aad And The Thamud Nation_ Qur'an Tafseer

Famous 100 fabricated hadith:

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত বনাম প্রচলিত ছালাত **-আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ (পর্ব-২৫)