প্রচলিত ভুল ও কুসংস্কার | Al Itisam

আব্দুল বারী বিন সোলায়মান

(পর্ব-৪)

(৩১) আযান শুনে মাথায় কাপড় দেওয়া :

আযান শুনে অনেক নারীকে মাথায় কাপড় দিতে দেখা যায়।  শরী‘আতে এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। যদি ছওয়াবের নিয়্যতে এই কাজ করা হয়, তাহলে তা বিদ‘আত বলে গণ্য হবে। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ. ‘যে ব্যক্তি এমন কোনো আমল করল, যার ব্যাপারে আমাদের কোনো নির্দেশনা নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[1]  এটা প্রচলিত কুসংস্কার মাত্র। হয়ত বা মনে করে- আযান হচ্ছে,  আল্লাহর  ইবাদতের দিকে আহ্বান করা হচ্ছে, এই অবস্থায় খালি মাথায়, বেপর্দা হয়ে থাকি কী করে? তাই মাথায় কাপড় দেয়। হাস্যকর ব্যাপার হলো, যে নারী ছালাতই আদায় করে না, ছালাতের মতো ফরয বিধানকে অমান্য করে চলতে যার অন্তর কাঁপে না, আযান শুনে মাথায় কাপড় দিয়ে সে আবার কী দেখাতে চায়?

(৩২) তাশাহহুদের বৈঠকে বসে সিজদার স্থানে দৃষ্টি রাখা :

অনেকেই তাশাহহুদের বৈঠকে বসে দৃষ্টি রাখে সিজদার স্থানে। মনে করে ছালাতের অন্য সব স্থানের মতো[2]  এখানেও সিজদার স্থানে দৃষ্টি রাখতে হবে। কিন্তু তা ভুল। বরং তাশাহহুদে বসে তর্জনী আঙ্গুলের ইশারার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল ধ যখন তাশাহহুদে বসতেন, তখন ডান হাতকে ডান উরুর উপর ও বাম হাতকে বাম উরুর উপর রাখতেন এবং তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করতেন। তার দৃষ্টি তার ইশারাকে অতিক্রম করে (সামনে) যেত না।[3]

(৩৩) শিরকী প্রবাদ : ভুতের মুখে রাম নাম

স্ববিরোধী আচরণের কথা বুঝাতে বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ চালু আছে, ‘ভুতের মুখে রাম নাম’। হিন্দু সমাজের বিশ্বাস মতে, জিন-ভুতের দ্বারা ভয় তাড়িত হলে কেউ যদি তাদের পূজনীয় ভগবান ‘রাম’-এর নাম উচ্চারণ করে, তাহলে জিনের প্রভাব ও ক্ষতি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু স্বয়ং ভুতই যদি ‘রাম’ নাম উচ্চারণ করতে থাকে, তাহলে সেখান থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? তাই কোনো অপরাধী নিজেই যখন অন্যকে অপরাধী সাব্যস্ত করে, তখন এই প্রবাদ ব্যবহার করা হয়।

বিশ্বাসগত দিক থেকে এটা ক্ষমার অযোগ্য শিরক। কারণ জিন-ভুত তাড়াতে আল্লাহ ব্যতীত অন্য যে কাউকে ডাকা সুস্পষ্ট শিরক। তাই এই প্রবাদ অবশ্য পরিত্যাজ্য।

(৩৪) ভুল বিশ্বাস : পৃথিবী ষাঁড়ের শিংয়ের উপর বিদ্যমান

অনেক মানুষের মুখে শোনা যায়, পুরো পৃথিবী একটি ইয়ে বড় মোটা-তাজা ষাঁড়ের শিংয়ের উপর বিদ্যমান আছে। ষাঁড়টি যখন মাথা নাড়ায়, তখন পৃথিবীতে ভূমিকম্প হয়। এটা সম্পূর্ণ আজগুবী কথা। এর না আছে কোনো শারঈ ভিত্তি, না আছে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি।

(৩৫) আল্লাহকে গালি দেওয়া : আগুন লাগা রোদ/বৃষ্টি/বাতাস

গ্রামে-গঞ্জে শোনা যায়, হঠাৎ বৃষ্টি এসে যদি শুকাতে দেওয়া জিনিসপত্র, কাপড়-চোপড় কিংবা ফল-ফসল ভিজিয়ে দেয়, তাহলে অনেক মহিলা বলে ফেলে ‘আগুন লাগা বৃষ্টি’। অথবা এর বিপরীতে রোদের কারণে যদি কোনো ক্ষতি হয়, তখন বলে বসে ‘আগুন লাগা রোদ’। আবার হঠাৎ দমকা হাওয়া বা ঝড় এসে যদি কোনো কিছু উড়িয়ে নিয়ে চলে যায় বা তছনছ করে দেয়, তখন বাতাস বা ঝড়ো-হাওয়াকে গালি দিয়ে বলে ফেলে ‘আগুন লাগা ঝড়/বাতাস’। এভাবে বলে মূলত রোদ, বৃষ্টি, ঝড় বা বাতাসের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে গালি দেওয়া হয়। আর এগুলো তথা প্রকৃতিকে গালি দেওয়া মূলত আল্লাহকে গালি দেওয়া। আবু হুরায়রা প থেকে বর্ণিত, রাসূল ধ বলেছেন,

قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ:  يُؤْذِينِى ابْنُ آدَمَ ، يَسُبُّ الدَّهْرَ وَأَنَا الدَّهْرُ ، بِيَدِى الأَمْرُ ، أُقَلِّبُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ.

‘আল্লাহ বলেছেন, ‘আদম সন্তান আমাকে কষ্ট দেয়, তারা যুগকে গালি দেয়। অথচ আমিই হলাম যুগ (যুগের স্রষ্টা)। আমার হাতেই সবকিছুর ক্ষমতা। আমিই দিন ও রাতকে পরিবর্তন করি’।[4]

(৩৬) চিন্তা না করা থেকে ভুল : বোরকার কোমরের ফিতা বেঁধে রাখা

কিছু মা-বোন পর্দা করার জন্য বোরকা পরে, কিন্তু না বুঝে অথবা চিন্তা না করার ফলে একটি ভুল কাজ করে ফেলে। তা হলো- বোরকার কোমরের ফিতা বেঁধে রাখে। পর্দার উদ্দেশ্য হলো নিজের শারীরিক গঠন, অবয়ব, আকার-আকৃতি বেগানা পুরুষের দৃষ্টি থেকে আড়াল করা। এজন্য শরী‘আতে নারী-পুরুষ সবার জন্যই ঢিলেঢালা পোশাক পরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোমরের ফিতা বাঁধলে কী হয়? একজন নারীর বডি শেইপ তথা শরীরের অবয়ব সম্পূর্ণ প্রকাশ হয়ে পড়ে, যা পর্দা পরিপন্থী। তাই দ্বীনদার মা-বোনদের থেকে বোরকার ফিতা বাঁধার অভ্যাস বর্জন করা একান্ত কাম্য।

(৩৭) ছহীহ আমলের ভুল সময় : সকাল-সন্ধ্যায় সূরা ইখলাছফালাক্ব ও নাস পড়ে শরীর মাসাহ করা

عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا أَوَى إِلَى فِرَاشِهِ نَفَثَ فِى كَفَّيْهِ بِقُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ وَبِالْمُعَوِّذَتَيْنِ جَمِيعًا، ثُمَّ يَمْسَحُ بِهِمَا وَجْهَهُ، وَمَا بَلَغَتْ يَدَاهُ مِنْ جَسَدِهِ. قَالَتْ عَائِشَةُ فَلَمَّا اشْتَكَى كَانَ يَأْمُرُنِى أَنْ أَفْعَلَ ذَلِكَ بِهِ.

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) যখন বিছানায় যেতেন, তখন ‘কুল হুওয়াল্লাহ আহাদ এবং ফালাক্ব ও নাস পড়ে দুই হাতে ফুঁক দিতেন। অতঃপর দুই হাত দিয়ে চেহারা এবং শরীরের যতটুকু হাত পৌঁছত, ততটুকু মাসাহ করতেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, যখন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তখন তিনি আমাকে সেগুলো পড়ে তাকে ফুঁক দেওয়ার আদেশ দিতেন।[5]

হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয়, রাসূল (ছাঃ) এই আমলটি করতেন রাতে শোয়ার সময়। কিন্তু আমাদের দেশের কিছু মানুষকে দেখা যায়, তারা ফজর ও মাগরিবের ছালাতের পর এই আমলটি করে থাকে। অথচ এর স্বপক্ষে কোনো দলীল নেই। আর যে আমলের পক্ষে শরী‘আতের কোনো দলীল নেই, তা বিদ‘আত।[6]  তাই ফজর ও মাগরিবের পরে এই আমল করা থেকে বিরত থাকা একান্ত যরূরী।

(৩৮) ভুল প্রচলন : ফাতিমা (রাঃ)-কে মা ফাতিমা’ বলা

রাসূল ধ-এর সবচেয়ে আদরের কন্যা ছিলেন ফাতিমা (রাঃ)। তিনি তাকে অত্যধিক মহব্বত করতেন। তিনিও তাকে অত্যধিক মহব্বত করতেন।[7]  তাই মুমিন হিসাবে আমাদের তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো একান্ত কর্তব্য। কিন্তু সম্মান জানাতে এক শ্রেণির মানুষ তার নাম বলার সময় বলে থাকে ‘মা ফাতিমা’। দেখার বিষয় হলো, ফাতিমা (রাঃ)-কে ‘মা’ বলা কতটুকু যৌক্তিক? সত্যি কী তিনি আমাদের ‘মা’-এর মধ্যে পড়েন? একটু কুরআন থেকে দেখি। আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ছাঃ) ও তার স্ত্রীদের সম্পর্কে বলেছেন, النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ ‘নবী মুমিনদের জন্য তাদের নিজের চেয়েও বেশি কাছের এবং তার স্ত্রীগণ তাদের মাতা’ (আহযাব, ৬)। তাহলে আয়াত থেকে প্রমাণিত হচ্ছে, রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণ মুমিনদের মা। যদি তার স্ত্রীগণ আমাদের মা হন, তাহলে তার মেয়েগণ আমাদের কী হবেন? অবশ্যই বোন। তাহলে রাসূল (ছাঃ)-এর মেয়ে ফাতিমা (রাঃ)-কে ‘মা ফাতিমা’ বলাটা অযৌক্তিক নয় কি? তাছাড়া আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীদের মা সম্বোধন করে বলে থাকি, ‘মা খাদীজা, মা আয়েশা’। আর ফাতিমা (রাঃ) হলেন মা খাদীজার গর্ভজাত কন্যা। তাহলে একদিকে মাকে ‘মা খাদীজা’ বলা, অপরদিকে তার মেয়েকে ‘মা ফাতিমা’ বলা হাস্যকর নয় কি?

খুব সম্ভব এই প্রচলনটা মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে ‘আহলে বায়ত’ তথা আলী (রাঃ)-এর পরিবার নিয়ে বাড়াবাড়িকারী শী‘আদের কাছ থেকে। আলী (রাঃ)-কে তারা তাদের শ্রেষ্ঠ ইমাম মনে করে। আর যেহেতু তিনি তাদের শ্রেষ্ঠ ইমাম, তাই তার স্ত্রী ফাতিমা (রাঃ)-কে তারা ‘মা’ বলে মনে করে থাকে। সেই থেকে তারা তাকে ‘মা ফাতিমা’ বলে সম্বোধন করে থাকে। আল্লাহই ভালো জানেন।

(৩৯) বিক্রিত মাল ফেরত না নেওয়া :

‘বিক্রিত মাল ফেরত নেওয়া হয় না’ এটা আমাদের দেশে মার্কেটিংয়ের নিয়ম হয়ে গেছে বলা চলে। যদিও বিষয়টি না জায়েয কিছু নয়। বরং ক্রেতা স্থান ত্যাগ করার সাথে সাথে ফেরত দেওয়ার অধিকার শেষ হয়ে যায় অথবা ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে হওয়া চুক্তিই হয় চূড়ান্ত।[8]  তথাপি নিরুপায় অবস্থায় বা যরূরী প্রয়োজনে ক্রেতা যদি পণ্য ফেরত দিতে আসে, আর পণ্যটি যদি অক্ষত থাকে, তাহলে বিক্রেতার সেই পণ্য ফেরত নেওয়া উচিত। কারণ ছহীহ হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ أَقَالَ مُسْلِمًا أَقَالَهُ اللَّهُ عَثْرَتَهُ.

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি (প্রয়োজনে খাতিরে) কোনো মুসলিম ব্যক্তির সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার ভুল-ভ্রান্তি এড়িয়ে যাবেন’।[9]

(৪০) শিরক : ফলগাছ বা ফসলের জমির গাছে গরু-ছাগলের মাথাচোয়ালের হাড্ডিভাঙ্গা হাড়ি-পাতিল ইত্যাদি রাখা

বদ নযর ও বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অনেকেই ফলগাছ ও ফসলের জমিতে গরু-ছাগলের মাথা রেখে দেয়। গাছের ডালে গরুর চোয়ালে হাড্ডি ঝুলিয়ে রাখে। ফসলের জমিতে ব্যবহৃত কালিমাখা ভাঙ্গা পাতিল রেখে দেয়। এসবই শিরক। শরী‘আত পরিপন্থী কাজ। রাসূল (ছাঃ) তার এক ছাহাবীকে লক্ষ্য করে বলেন, يَا رُوَيْفِعُ لَعَلَّ الْحَيَاةَ سَتَطُولُ بِكَ بَعْدِى فَأَخْبِرِ النَّاسَ أَنَّهُ مَنْ عَقَدَ لِحْيَتَهُ أَوْ تَقَلَّدَ وَتَرًا أَوِ اسْتَنْجَى بِرَجِيعِ دَابَّةٍ أَوْ عَظْمٍ فَإِنَّ مُحَمَّدًا صلى الله عليه وسلم مِنْهُ بَرِىءٌ.. ‘হে রুওয়াফে! সম্ভবত তুমি দীর্ঘদিন হায়াত পাবে। অতএব তুমি মানুষদের জানিয়ে দিবে, যে ব্যক্তি দাড়িতে গিরা দেয় অথবা পশুর গলায় ধনুকের তার (প্রাণির পায়ের রগ দিয়ে তৈরি) ঝুলায় অথবা পশু-প্রাণির গোবর কিংবা হাড্ডি দিয়ে শৌচকার্য করে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাদের থেকে মুক্ত’।[10]

রাসূল (ছাঃ) আরও বলেন, مَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًا وُكِلَ إِلَيْهِ ‘যে ব্যক্তি কোনো কিছু ঝুলাল, তাকে তার দিকেই সোপর্দ করে দেওয়া হয়’।[11]

(৪১) নামের ভুল উচ্চারণ : মারদুবিয়্যাহ (مردويه) ও রাহাবিয়্যাহ (راهويه)

ইতিহাসের একজন শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ ও মুফাসসিরের নাম أبو بكر أحمد بن موسى بن مردويه (৩২৩-৪১০ হিজরী)। তিনি ছহীহ বুখারীর উপর ‘মুসতাখরাজ’ গ্রন্থ রচনা করেছেন। হাফেয ইবনে কাছীর তার তাফসীরে তিন শতাধিক জায়গায় তার উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তার নাম বলতে গিয়ে অনেকেই ভুল করে বলে, ‘মারদুবিয়্যাহ’। আবার ইমাম বুখারীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উস্তায হলেন إسحاق بن رَاهويه। তার নামের উচ্চারণেও ভুল পরিলক্ষিত হয়। অনেকে বলেন, ‘রাহাবিয়্যাহ’। সঠিক কথা হলো, উভয় নামের প্রথম অংশের উচ্চারণের ব্যাপারে ভিন্নমত থাকলেও শেষের অংশ وَيْه এর উচ্চারণের ব্যাপারে কোনো ভিন্নমত নেই। সবাই একে ‘ওয়াইহ্’ পড়েছেন। পূর্ণনামের উচ্চারণ হবে ‘مَرْدُوَيْه (মারদুওয়াইহ্) ও رَاهْوَيْه (রাহ্ওয়াইহ্)’। অবশ্য কেউ কেউ যবর দিয়ে ‘ مَرْدَوَيْه (মারদাওয়াউহ্) ও رَاهَوَيْه (রাহাওয়াউহ্)’ পড়েছেন। অনুরূপভাবে প্রখ্যাত নাহু বিশারদের নাম আমরা অনেকেই জানি,  سِيْبْوَيْه (সিব্ওয়াইহ্) বা سِيْبَوَيْه (সিবাওয়াইহ্)।

(৪২) মামা-ভাগ্নে কিংবা শিক্ষক-ছাত্রের মাঝে জামাই-শ্বশুরের সম্পর্ক ধরে ডাকা :

অনেক সময় বিয়ের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মামা-ভাগ্নে, চাচা-ভাতিজা, শিক্ষক-ছাত্রের মাঝে তারল্যের আচরণ দেখা যায়। একে অপরকে তারা শ্বশুর-জামাই সম্পর্ক ধরে ডাকে। মামা, চাচা, খালু কিংবা শিক্ষক ভাগ্নে, ভাতিজা, ছাত্রকে বলে, ‘তোমার সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলাম’। ছেলেও বলে ফেলে, ‘আচ্ছা, আমিও বিয়ে করে নিলাম’। অথচ এর মাধ্যমে যে কী মহাকা- ঘটে গেল, তা কেউ চিন্তা করে না। বিয়ের ক্ষেত্রে শর্ত হলো, ‘প্রকৃত অভিভাবক ও ছেলের মাঝে ইজাব (অভিভাবকের পক্ষ থেকে বিয়ের কথা পেশ করা) ও কবুল (ছেলের পক্ষ থেকে কবুল বলা) হওয়া’। যদি এমনটা হয়, তাহলে তাদের মাঝে সত্যি সত্যি বিবাহ বন্ধন সম্পন্ন হয়ে যাবে। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তিনটি বিষয় এমন, যার চূড়ান্তও চূড়ান্ত, হাশি-তামাশাও চূড়ান্ত। বিয়ে, তালাক ও তালাকের পর স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়া’।[12]

তাই হাসি-তামাশা করেও যদি প্রকৃত অভিভাবক ও ছেলের মাঝে বৈবাহিক চুক্তি সম্পাদিত হয়ে যায়, তাহলে তাতে বিবাহ সম্পন্ন হয়ে যাবে। অবশ্য ছেলেকে প্রাপ্ত বয়স্ক তথা বালেগ হতে হবে। এ অবস্থায় উক্ত মেয়ের অন্য কোথাও বিবাহ দিতে পারবে না, কারণ সে বিবাহিত। আরেক স্বামীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে (নিসা, ২৪)। যদি অন্য কোথাও বিবাহ দিতে হয়, তাহলে হাসি-তামাশা করে বিবাহ দেওয়া ঐ জামাইয়ের কাছ থেকে তালাক নিয়ে তিন হায়েয ইদ্দত পালন করার পর বিয়ে দিতে পারবে (বাক্বারাহ, ২২৮, ২৩৫)। অপরদিকে ছেলে যদি এভাবে সম্পর্ক পাতিয়ে চারজনকে শ্বশুর বানিয়ে ফেলে, তাহলে আগের কোনো স্ত্রীকে তালাক না দেওয়া পর্যন্ত অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে না। আবার যদি চাচা, মামা, খালু বা অন্য কারও বড় মেয়ের সাথে এভাবে বিবাহ সম্পাদিত হয়ে যায়, তাহলে ঐ ব্যক্তির ছোট মেয়েকে বিবাহ করতে পারবে না। কারণ দুই বোনকে একই সাথে বিবাহ করে রাখা জায়েয নয় (নিসা, ২৩)। এ ধরনের আরও বহুবিধ সমস্যা দাঁড়িয়ে যাবে। তাই এভাবে জামাই-শ্বশুর সম্পর্ক পাতানো অনুচিত।

(৪৩) কুসংস্কার : রোববারে বাঁশ না কাটা

কোনো কোনো এলাকায় রোববারে বাঁশ কাটা হয় না। বিশ্বাস করা হয়, রোববারে বাঁশের গায়ে জ্বর আসে। এই জ্বর অবস্থায় বাঁশ কাটলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারে। অথচ ‘বাঁশের গায়ে জ্বর হয়’ এটা সম্পূর্ণ অলীক কল্পনা মাত্র। এর কোনো বাস্তবতা নেই। এগুলো হয়ত তান্ত্রিকদের পক্ষ থেকে আসা অসার কথা। ইসলামে এই ধরনের শুভাশুভের কোনো স্থান নেই। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم  قَالَ «لاَ عَدْوَى ، وَلاَ طِيَرَةَ ، وَلاَ هَامَةَ ، وَلاَ صَفَرَ»..

‘আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, ‘ছোঁয়াচে রোগ বলতে কিছু নেই। অশুভ লক্ষণও নেই। নেই পেঁচার কোনো অশুভ লক্ষণ। নেই ছফর মাসের কোনো অশুভ লক্ষণ’।[13]

(৪৪) স্থলযানে আরোহনের সময় পঠিতব্য দোআ :

যারা ট্রেনে ভ্রমণ করেছেন তারা অনেকেই শুনেছেন, ছাড়ার পূর্ব মুহূর্তে ট্রেনে কিছুক্ষণ কুরআন তেলাওয়াতের অডিও রেকর্ড বাজানো হয়। তেলাওয়াত শেষে ট্রেনের গন্তব্য ঘোষণা করার পর একটি দো‘আ পড়া হয়। দো‘আটি হলো- بِسْمِ اللهِ مَجْرهَا وَمُرْسَاهَا إِنَّ رَبِّي لَغَفُورٌ رَحِيمٌ অর্থ: ‘আল্লাহর  নামেই এর  (নৌকা) চলা ও থেমে যাওয়া। নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক অতি ক্ষমাশীল ও দয়ালু’ (হূদ, ৪১)। এছাড়াও বাস, সিএনজি, লেগুনাসহ বিভিন্ন গণপরিবহনে এই দো‘আটি বাংলায় লেখা থাকে। অথচ দো‘আটি স্থলযানে পড়ার জন্য নয়। বরং তা জলযানে আরোহন করলে পড়তে হয়। নূহ (আঃ)-এর জাতি যখন তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল এবং তার আনীত বাণীকে অস্বীকার করল, সাড়ে নয়শ’ বছর দাওয়াত দিয়েও মুষ্টিমেয় কিছু লোক ব্যতীত আর কেউ ঈমান আনল না, তখন আল্লাহ নূহ (আঃ)-কে একটি নৌকা তৈরি করার আদেশ দিলেন। অতঃপর আল্লাহর  নির্দেশে যখন তুফান (জলোচ্ছ্বাস) শুরু হলো এবং ভূ-গর্ভ থেকে পানি বের হতে শুরু করল, তখন আল্লাহ নূহ (আঃ) ও তার অনুসারীদের এই দো‘আ পড়ে নৌকায় আরোহন করার নির্দেশ দিলেন। তাই এটি যে জলযানে আরোহনের দো‘আ স্পষ্ট বুঝা যায়।

অপরদিকে, ‘স্থলযানে পড়ার দো‘আটি সূরা যুখরুফের ১৩ ও ১৪ নাম্বার আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, যখন সেই সকল প্রাণীর পিঠে আরোহন করবে, তখন পড়বে, سُبْحَانَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِينَ – وَإِنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُونَ অর্থ: ‘পবিত্র ও মহান তিনি, যিনি এদেরকে আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যদিও আমরা সমর্থ ছিলাম না এদেরকে বশীভূত করতে। আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করব’ (যুখরুফ, ১৩-১৪)। রাসূল (ছাঃ) সফরে যাওয়ার সময় বাহনের পিঠে আরোহনের সময় তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলে এই দো‘আটি পড়তেন।[14]  আলী (রাঃ)-এর কাছে একটি পশু নিয়ে আসা হলো। তিনি বাহনের ‘পা-দানি’তে পা দেওয়ার সময় পড়লেন ‘বিসমিল্লাহ’। বাহনের পিঠে সোজা হয়ে বসার সময় পড়লেন ‘আল-হামদুলিল্লাহি’। অতঃপর উক্ত দো‘আটি পড়লেন।[15]

(চলবে)

[1].  ছহীহ বুখারী, হা/২৬৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮।

[2]. ইরওয়াউল গালীল, ২/৭৩;  ছিফাতু ছালাতিন নাবী (ছাঃ), ১/৮৯।

[3]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬১৪৫; নাসাঈ, হা/১২৭৫; আবু দাঊদ, ৯৯০।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৮২৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২২৪৬; মিশকাত, হা/২২।

[5].  ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৪৮, ৫০১৭; আবুদাঊদ, হা/৫০৫৬।

[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮; ছহীহ বুখারী, হা/২৬৯৭।

[7]. আবুদাঊদ, হা/৫২১৭;  আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৯৭১।

[8]. ছহীহ বুখারী, হা/২১০৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৩১; মিশকাত, হা/২৮০১।

[9]. আবুদাঊদ, হা/৩৪৬২; মিশকাত, হা/২৮৮১।

[10]. আবুদাঊদ, হা/৩৬; মিশকাত, হা/৩৫১।

[11]. তিরমিযী, হা/২০৭২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৮০৩; মিশকাত, হা/৪৫৫৬।

[12]. আবুদাঊদ, হা/২১৯৪; তিরমিযী, হা/১১৮৪; মিশকাত, হা/৩২৮৪।

[13]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৫৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২২২২।

[14]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৪২; আবুদাঊদ, হা/২৫৯৯; মিশকাত, হা/২৪২০।

[15]. আবুদাঊদ, হা/২৬০২; তিরমিযী, হা/৩৪৪৬; মিশকাত, হা/২৪৩৪।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ

Comments

|| Popular Posts ||

Sura al imran Chapter___ 3_ Tafser

Bilqis(Queen of Sheba): Tafseer of Ibn katheer : Qur'anic Story

Eid e Milad bidah | Ruling On Celebrating The Birthday Of Prophet Muhammad

Dua for Relief Distress, Laziness, Debts :

গর্ভাবস্থায় বমি :

Hadith on Shukr: Take advantage of five blessings before deprived

তামাত্তু হজ্জ : Hajj e tamattu bangla