বিষয়__ সালাতের (নামাজ) গুরুত্ব ও ফযীলত |
Assalamu Aalaikum..
إن الحمد لله نحمد ونستعينه ونستغفره ونعوذ بالله من شرو أنفسنا ومن سيئات أعمالنا من يهد الله فلا مضل له ومن يضلل فلا هادي له وأشهد أن لا إله إلا الله وأن محمداً عبده ورسوله صلى الله عليه وسلم! وبعد:
সালাত কালেমা শাহাদতের স্বীকৃতির পরই ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। আর সালাতে অলসতাকারীদের মধ্যে শ্রেণিভেদ রয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ এমন যে সে কখনও সালাত আদায় করে না, এটি হলো কুফুরী। তাদের মধ্যে কেউ সালাতের ব্যাপারে অলসতাকারী। বাস্তবে তাদের আধিক্যই আমি দেখলাম অথচ সালাত হলো ইসলামের বৃহত্তম নিদর্শন ও প্রতীক। আবার এমনও লোক আছে যে, এক ওয়াক্ত সালাত পড়ে তো অন্য ওয়াক্ত ছেড়ে দেয়, এর বিধানও প্রথম শ্রেণির মতো। তাদের মধ্যে কেউ জামা‘আতে সালাত আদায়ে অলসতা করে। কেউ তো ফজর সালাতের জামা‘আতে অলসতা করে, এগুলো বড় ধরণের ত্রুটি এবং অবহেলা। এ জন্য আমি এ ক্ষুদ্র বইখানি লিখার প্রয়াস চালিয়েছি এবং বইটি সংক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করেছি, তাই টীকা টিপ্পনি সংযোজন থেকে বিরত হয়ে হাদীস উল্লেখ করে সাথে সাথেই মূল হাদীস গ্রন্থের উদ্ধৃতি পেশ করেছি, যেন পাঠকের সুবিধা হয় এবং জনসাধারণের সহজলভ্য হয় আর এটিই হলো পুস্তিকাটি রচনার প্রকৃত উদ্দেশ্য। আমি পুস্তিকাটির মধ্যে যা ভুল-ত্রুটি রয়েছে তা সংশোধন ও এর নির্ভরযোগ্যতার জন্য তা মাননীয় ড. শাইখ সালেহ ইবন ফাওযান আল-ফাওযানের নিকট পেশ করি। তিনি আমার এই আবেদন গ্রহণ করেন। আমি তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আল্লাহ যেন তাকে উত্তম প্রতিদান দেন এবং তার জ্ঞানের মাধ্যমে জনসাধারণকে উপকৃত করেন।
দুরূদ ও সালাম বর্ষিত হউক আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণের ওপর।
লেখক:
আব্দুল্লাহ ইবন সা‘দ আল ফালেহ
কালেমার সাক্ষ্য দেওয়ার পর সালাতই ইসলামের অধিকতর গুরুত্ব ও তাগিদপূর্ণ রুকন বা স্তম্ভ এবং ইসলামের সবচেয়ে বড় আনুষ্ঠানিকতা, প্রতীক ও উত্তম ইবাদত। এ জন্যেই আল্লাহ তা‘আলা সালাতকে ঈমান নামে অভিহিত করেছেন। যেমন তাঁর বাণী:
﴿وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيُضِيعَ إِيمَٰنَكُمۡ﴾ [البقرة: ١٤٣]
“আল্লাহ এরূপ নন যে, তোমাদের ঈমান (সালাত)-কে নষ্ট করে দিবেন।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৪৩]
বিগত শরী‘আতসমূহের মধ্য থেকেও কোনো শরী‘আত সালাতবিহীন ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন,
﴿رَبِّ ٱجۡعَلۡنِي مُقِيمَ ٱلصَّلَوٰةِ وَمِن ذُرِّيَّتِي﴾ [ابراهيم: ٤٠]
“হে আমার রব! আমাকে সালাত প্রতিষ্ঠাকারী কর এবং আমার বংশধরদের মধ্যে থেকেও।” [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ৪০]
এবং ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন,
﴿وَأَوۡصَٰنِي بِٱلصَّلَوٰةِ وَٱلزَّكَوٰةِ مَا دُمۡتُ حَيّٗا﴾ [مريم: ٣١]
“এবং তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি ততদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে।” [সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৩১]
এবং ইসমাঈল আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন,
﴿وَكَانَ يَأۡمُرُ أَهۡلَهُۥ بِٱلصَّلَوٰةِوَٱلزَّكَوٰةِ وَكَانَ عِندَ رَبِّهِۦ مَرۡضِيّٗا ٥٥ ﴾ [مريم: ٥٥]
“সে তার পরিজনবর্গকে সালাত ও যাকাতের নির্দেশ দিত এবং সে ছিল তার রবের সন্তোষভাজন।” [সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৫৫]
যাবতীয় ফরয বিষয় জিবরাঈল আলাইহিস সালাম মারফত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ফরয হয়েছে, কিন্তু সালাতের জন্য তাঁকে আল্লাহর নিকটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেখানে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সাথে কথপোকথন করেন এবং তাঁর প্রতি (পঞ্চাশ) ৫০ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেন। অতঃপর তা থেকে কমিয়ে ৫ ওয়াক্ত বাকী রাখা হয় যার নেকী ৫০ ওয়াক্তেরই সমান। আল্লাহরই সকল প্রশংসা ও অনুগ্রহ।
সালাত ইসলাম এবং কুফুরীর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«بين الرجل وبين الشرك أو الكفر ترك الصلاة»
“মানুষ এবং শির্ক কুফুরীর মধ্যে পার্থক্য সালাত ছেড়ে দেওয়া”। (সহীহ মুসলিম)
তিনি আরো বলেন,
«العهد الذي بيننا وبينهم الصلاة فمن تركها فقد كفر»
“আমাদের ও তাদের (কাফিরদের) মধ্যে যে পার্থক্য তা হলো সালাত। অতএব, যে সালাত ছেড়ে দিল সে কুফুরী করল।” (আবু দাউদ, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবন মাজাহ)
প্রখ্যাত তাবেঈ শাকীক ইবন আব্দুল্লাহ আল-উকাইলী বলেন, “সাহাবায়ে কিরাম সালাত ব্যতীত অন্য কোনো আমল ছেড়ে দেওয়াকে কুফুরী মনে করতেন না।” (সুনান তিরমিযী)
উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “যে ব্যক্তি সালাত ছেড়ে দিল ইসলামে তার কোনো অংশ নেই।”
উল্লিখিত ও অন্যান্য দলীলসমূহ সালাত পরিত্যাগকারী বড় কুফুরীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ; যদিও সে পরিত্যাগকারী ব্যক্তি সালাত ফরয হওয়াকে অস্বীকার না করে। আর এ মত পোষণ করেন ঈমাম আহমদ রহ. এবং তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিম্নোক্ত হাদীস থেকে দলীল গ্রহণ করেন:
«أول ما تفقدون من دينكم الأمانة وآخر ما تفقدون منه الصلاة»
“সর্বপ্রথম তোমরা তোমাদের দীনের যা হারাবে তাহলো আমানত এবং সর্বশেষ দীনের যা হারাবে তাহলো সালাত”। (বাইহাকী হাদীসটিকে তার শু‘আবুল ঈমানে বর্ণনা করেন)
ইমাম আহমদ রহ. বলেন, “সুতরাং ইসলাম থেকে চলে যাওয়া সর্বশেষ বস্তু যখন সালাত তখন যে বস্তুর শেষ চলে যায় সে বস্তু সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়। এ জন্য আপনাদের দীনের সর্বশেষ অংশ (সালাত)-কে যথাযথভাবে আঁকড়ে ধরুন, আল্লাহ আপনাদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন।” (ইমাম আহমদের কিতাবুস সালাত)
বর্তমান যুগে আমাদের বিশিষ্ট ওলামায়ে কেরাম সালাত পরিত্যাগকারীর ব্যাপারে কুফুরীর ফাতওয়া দিয়েছেন, আর তাদের শীর্ষে রয়েছেন, মাননীয় (সাবেক) মুফতী শাইখ আব্দুল আযীয ইবন আব্দুল্লাহ ইবন বায ও আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন উসাইমীন রহ.।
(ক) সালাত পরিত্যাগকারীর ইহকালীন বিধান: সালাত আদায়কারী মুসলিম নারীর সাথে বেনামাযীর বিয়ে দেওয়া নাজায়েয। তার অভিভাবকত্ব বিলুপ্ত, তার জবাহকৃত গোশত খাওয়া নাজায়েয, সে তার কোনো আত্মীয়ের সম্পত্তির অংশ পাবে না। তেমনি তার আত্মীয়গণও তার থেকে কোনো অংশের অধিকারী হবে না, মারা গেলে তার জানাযা আদায় করা যাবে না, তার ক্ষমা ও করুণার জন্য দো‘আ করা যাবে না, মুসলিমদের কবরস্থানে দাফন করা হবে না এবং সে দীনী ভাই হিসেবে গণ্য হবে না, বরং তার থেকে বিমুখ হওয়া ও তার সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন ছিন্ন করা ওয়াজিব। (শাইখ মুহাম্মাদ ইবন উসাইমীনের “সালাত পরিত্যাগকারীর বিধান” নামক রিসালা থেকে সংকলিত)
(খ) সালাত পরিত্যাগকারীর পরকালীন বিধান:
(১) বেনামাযীকে কবরে শাস্তি দেওয়া হবে, যেমন সহীহ বুখারীতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক স্বপ্নের বর্ণনায় রয়েছে: “তিনি চিৎ অবস্থায় শায়িত এক ব্যক্তির নিকট আসলেন, এমতাবস্থায় একটি পাথর হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্য একজন, অতঃপর সে উক্ত পাথর দিয়ে তার (শায়িত ব্যক্তির) মাথায় আঘাত করছে, যার ফলে তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, পাথরটি ছিটকে দূরে চলে যাচ্ছে, পুনরায় সে দৌড়ে গিয়ে পাথরটি নিয়ে ফিরা মাত্র উক্ত ব্যক্তির মাথা পূর্বের ন্যায় ঠিক হয়ে যাচ্ছে। পুনরায় ঐ ব্যক্তি আপন স্থানে ফিরে তাকে ঐ ভাবেই (শাস্তি) দিচ্ছে যেভাবে প্রথমবার দিয়েছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেন তখন দুই ফিরিশতা তাঁকে অবহিত করেন যে, এতো ঐ ব্যক্তি যে কুরআন পড়ত, কিন্তু তার প্রতি আমল করত না এবং ফরয সালাত ছেড়ে ঘুমাত।
আমার প্রিয় ভাই! দেখুন কত বড় শাস্তি, শুধু এই জন্য যে বেনামাযী ফরয সালাতকে মাথায় বড় বোঝা মনে করত, তাই মাথায় পাথর মেরে মেরে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, আল্লাহ আমাদেরকে এ থেকে রক্ষা করুন।
(২) কিয়ামতের দিন কাফির সরদার কারূন, ফির‘আউন, হামান ও উবাই ইবন খালফের সাথে বেনামাযীর হাশর হবে। যেমন, হাদীসে এসেছে:
«من حافظ عليها كانت له نوراً وبرهاناً ونجاة يوم القيامة، ومن لم يحافظ عليها لم تكن له نوراً ولا برهاناً ولا نجاة يوم القيامة وحشر مع قارون وفرعون وهامان وأبي بن خلفً»
“যে ব্যক্তি সালাতের হিফাযত করলো, সালাত তার জন্য কিয়ামতের দিন জ্যোতি, প্রমাণ ও নাজাতের উসীলা হবে, আর যে সালাতের হিফাযত করলো না, তার জন্য সালাত কিয়ামতের দিন জ্যোতি, প্রমাণ ও নাজাতের উসীলা হবে না এবং কারূন, ফির‘আউন, হামান এবং উবাই ইবন খালফের সাথে তার হাশর হবে।” (মুসনাদে ইমাম আহমদ)
ইমাম আহমদ রহ. এ হাদীসকে সালাত পরিত্যাগকারীর কুফুরীর ব্যাপারে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কেননা বড় বড় কাফিরদের সাথে বেনামাযীর হাশর হওয়ার জন্য তার কুফুরী সাব্যস্ত হওয়া চাই। ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “এই চার জনকে বিশেষভাবে এ জন্য উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা কাফিরদের নেতা।
(৩) বেনামাযী জাহান্নামে যাবে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَا سَلَكَكُمۡ فِي سَقَرَ ٤٢ قَالُواْ لَمۡ نَكُ مِنَ ٱلۡمُصَلِّينَ ٤٣﴾ [المدثر: ٤٢، ٤٣]
“তোমাদেরকে কিসে সাকার (জাহান্নাম)-এ নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে আমরা সালাত আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না।” [সূরা আল-মুদ্দাসসির, আয়াত: ৪২-৪৩]
(৪) বেনামাযী স্বীয় পরিবার এবং ধন-সম্পদ নষ্ট করে দেওয়ার চেয়েও অধিক ক্ষতিগ্রস্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الذي تفوته صلاة العصر كأنما وتر أهله وماله»
“যে ব্যক্তির আসর সালাত ছুটে গেল, তার যেন পরিবার ও ধন সম্পদ নষ্ট হয়ে গেল।” (সহীহ মুসলিম)
অতএব, যে সমস্ত সালাত ছেড়ে দেয় তার কি অবস্থা হবে?
(৫) বেনামাযীকে কিয়ামতের দিন জাহান্নামের এক খালে নিক্ষেপ করা হবে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَخَلَفَ مِنۢ بَعۡدِهِمۡ خَلۡفٌ أَضَاعُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَٱتَّبَعُواْ ٱلشَّهَوَٰتِۖ فَسَوۡفَ يَلۡقَوۡنَ غَيًّا ٥٩ ﴾ [مريم: ٥٩]
“তাদের পরে আসলো অপদার্থ পরবর্তীগণ, তারা সালাত নষ্ট করল ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করল। সুতরাং তারা অচিরেই “গাইয়া” প্রত্যক্ষ করবে।” [সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৫৯]
আপনি কি জানেন “গাইয়া” কী? গাইয়া হলো, জাহান্নামের একটি নদীর তলদেশ, যার গভীরতা অনেক, যেখানে রয়েছে রক্ত ও পুঁজের নিকৃষ্টতম আস্বাদ। (তাফসীর ইবন কাসীর)
গাইয়ার উক্ত তাফসীর আব্দুল্লাহ্ ইবন মাসউদ থেকে বর্ণিত হয়েছে, যেমন ইবনুল কাইয়্যেম রহ. কিতাবুস সালাতে উল্লেখ করেছেন।
প্রিয় পাঠক! দুনিয়া ও আখিরাতে পরকালে সালাতের অনেক উপকারিতা রয়েছে, নিম্নে সংক্ষেপে কতিপয় উল্লেখ করা হলো:
১। সালাত হিফাযত বা সংরক্ষণকারীর জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুতি হলো যে, তিনি তাকে জান্নাত দান করবেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ বান্দার ওপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন, যে তা হিফাযত করল তার জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুতি হলো যে, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন...।” (আবু দাউদ, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবন মাজাহ)
২। যে ব্যক্তি সালাতের হিফাযত করল তার জন্য সালাত জ্যোতি ও প্রমাণ হবে: অর্থাৎ সালাত তার ঈমানের দলীল হবে এবং কিয়ামতের দিন জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের কারণ হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে সালাতের হিফাযত করল সালাত তার জন্য জ্যোতি, প্রমাণ ও কিয়ামতের দিন মুক্তির কারণ হবে।” (ইতোপূর্বে পূর্ণ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে)
৩। সালাত বান্দা ও তার প্রতিপালকের মধ্যে সম্পর্ক গড়ার মাধ্যম: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَٱسۡجُدۡۤ وَٱقۡتَرِب﴾ [العلق: ١٩]
“আর সাজদাহ কর ও (আমার) নিকটবর্তী হও।” [সূরা আল-‘আলাক, আয়াত: ১৯]
অর্থাৎ আল্লাহর উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং সমস্ত সৎ কাজের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভ কর, আর সৎ কাজের মধ্যে আল্লাহর জন্য সাজদাহ হচ্ছে সবচেয়ে বড়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “বান্দা স্বীয় রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয় সাজদাহ অবস্থায়। অতএব, তোমরা সাজদায় বেশি-বেশি দো‘আ কর।” (সহীহ মুসলিম ও নাসাঈ)
প্রিয় পাঠক! দেখুন সালাতই হচ্ছে আপনার ও আল্লাহর মাঝে সম্পর্ক গড়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম। অতএব, আপনি যদি চান তবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে (সালাতের মাধ্যমে) বেশি-বেশি সাজদাহ ও রুকুর মাধ্যমে এ সম্পর্ক বৃদ্ধি করুন। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে বেশি-বেশি দো‘আ করার ওসীয়ত করেছেন।
৪। সালাত গুনাহ ও মন্দ কাজের কাফ্ফারা: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে কোনো মুসলিম ব্যক্তি সালাতের ওয়াক্ত পেল আর সালাতের জন্য উত্তমরূপে অযু করল যথাযথ খুশু-খুযু নিয়ে সালাত আদায় করল, ঠিকমত রুকু করল। এ সালাত তার বিগত গুনাহের কাফ্ফারা হবে যতক্ষণ পর্যন্ত সে কবীরা গুনাহে লিপ্ত না হবে। আর এই ফযীলত সব সময়ের জন্য।” (সহীহ মুসলিম)
প্রিয় পাঠক! উক্ত হাদীসের শেষ অংশের দিকে লক্ষ্য করুন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বলেছেন: “যতক্ষণ পর্যন্ত কবীরা গুনাহে লিপ্ত না হবে” কেননা কবীরা গুনাহ খাঁটি ও আন্তরিক তাওবা ব্যতীত মাফ হবে না।
৫। সালাত সর্বোত্তম আমলের অন্তর্ভুক্ত: আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন: সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি বলেন, “সময়মত সালাত আদায় করা”। আব্দুল্লাহ্ ইবন মাসউদ বলেন, তারপর কোনটি? তিনি বলেন, “পিতা-মাতার সাথে সৎ ব্যবহার করা”। আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ বলেন, আমি বললাম: তারপর কী? তিনি বললেন: “আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।” (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
৬। সালাতের মধ্যে রয়েছে ইহকালীন ও পরকালীন আত্মিক প্রশান্তি-আরাম এবং চক্ষু শীতলতা: আল্লাহ বলেন,
﴿أَلَا بِذِكۡرِ ٱللَّهِ تَطۡمَئِنُّ ٱلۡقُلُوبُ﴾ [الرعد: ٢٨]
“জেনে রাখ! আল্লাহর যিকিরেই আত্মা প্রশান্ত হয়।” [সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ২৮]
আর সম্পূর্ণ সালাতই আল্লাহর যিকির বরং সালাত আল্লাহর যিকির প্রতিষ্ঠার জন্যই প্রবর্তন করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَأَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَ لِذِكۡرِيٓ﴾ [طه: ١٤]
“আমার যিকিরের (স্মরণের) জন্য সালাত প্রতিষ্ঠা কর।” [সূরা ত্বাহা, আয়াত: ১৪]
এ জন্যই মুসলিমগণ সালাতের মধ্যে অর্জন করে সুখ-শান্তি ও আরাম। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলেন, “উঠো বিলাল এবং আমাদেরকে সালাতের মাধ্যমে আরাম পৌঁছাও।” (মুসনাদে আহমদ) এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আমার চক্ষু প্রশান্তি সালাতের মধ্যে নিহিত রয়েছে।” (সুনান নাসাঈ)
পক্ষান্তরে সালাত পরিত্যাগকারী হলো আল্লাহর যিকির (সালাত) বিমুখ, আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর যিকির থেকে বিমুখদের জন্য তার জীবন-যাপন সংকুচিত করার ওয়াদা করেছেন। তিনি বলেন,
﴿وَمَنۡ أَعۡرَضَ عَن ذِكۡرِي فَإِنَّ لَهُۥ مَعِيشَةٗ ضَنكٗا وَنَحۡشُرُهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ أَعۡمَىٰ ١٢٤﴾ [طه: ١٢٤]
“যে আমার স্মরণে বিমুখ থাকবে, অবশ্য তার জীবন-যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব।” [সুরা ত্বাহা, আয়াত: ১২৪]
এটা কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, আমরা সাধারণত সালাতে অলসতাকারীদেরকে দেখতে পাবো যে, তারা আত্মিক অস্থিরতা, স্নায়ুর চাপ ও নানা ধরণের মানসিক যন্ত্রনায় ভুগে।
৭। সালাত মুসলিমের ইহকাল ও পরকালের কাজ কর্মে সহায়ক: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَٱسۡتَعِينُواْ بِٱلصَّبۡرِ وَٱلصَّلَوٰةِ﴾ [البقرة: ٤٥]
“তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৪৫]
এ জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যায় পতিত হতেন তখনই ভয় ও ভীতির সঙ্গে দ্রুত সালাত পড়তে যেতেন। হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারের সম্মুখীন হতেন তখন সালাত আদায় করতেন।” (মুসনাদে আহমদ) সাবেত রহ. বলেন, “নবীগণ যখন কোনো বড় কাজের সম্মুখীন হতেন সালাতের দিকে অগ্রসর হতেন।” (তাফসীর ইবন কাসীর)
কারণ, সালাতই হলো বান্দা এবং তার রবের মধ্যে সম্পর্কের মাধ্যম, যেমন ইতোপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। অতএব মুসলিম যখন কোনো কাজের মনস্থ করবে সে মহিমান্বিত আল্লাহর স্মরণাপন্ন হবে যাঁর হাতে রয়েছে সব কিছুর ক্ষমতা, যিনি কোনো ব্যাপারে বলেন হয়ে যাও, আর তা হয়ে যায়, যিনি আর্ত অসহায়ের আহ্বানে সাড়া দেন এবং বিপদ দূরীভূত করেন। আল্লাহ তা‘আালা বলেন,
﴿أَمَّن يُجِيبُ ٱلۡمُضۡطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكۡشِفُ ٱلسُّوٓءَ﴾ [النمل: ٦٢]
“নাকি তিনি যিনি অসহায়ের আহ্বানে সাড়া দেন, যখন সে তাঁকে ডাকে এবং বিপদ-আপদ দূরীভূত করেন?” [সূরা আন-নামল, আয়াত: ৬২]
সালাতে অবহেলাকারী যখন কোনো বড় সমস্যায় পতিত হয় এবং বিপদে আচ্ছন্ন হয় তখন সে কার স্মরণাপন্ন হবে? সে তো আল্লাহ তা‘আলার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে বা সে তো শুধু কঠিন ও বিপদের সময় সালাত আদায় করে। অতএব, এ সালাত তার না কোনো উপকারে আসবে, না আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক গড়ে তুলবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তুমি আল্লাহকে সুখে-সাচ্ছন্দে চেন, আল্লাহ তোমাকে বিপদে-আপদে চিনবে।” (মুসনাদ আহমদ)
অবশ্য কেউ যদি কঠিন বিপদে-আপদে আল্লাহর নিকট তাওবা করে এবং সালাতের হিফাযতের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে, তবে আল্লাহ তাওবাকারীর তাওবা কবুল করেন।
৮। সালাতে রয়েছে ইহকাল ও পরকালের সফলতা: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قَدۡ أَفۡلَحَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ١ ٱلَّذِينَ هُمۡ فِي صَلَاتِهِمۡ خَٰشِعُونَ ٢﴾ [المؤمنون: ١، ٢]
“অবশ্যই মুমিনগণ সফলকাম হয়েছে, যারা নিজেদের সালাতে বিনয়-নম্র।” [সূরা আল-মুমিন, আয়াত: ১-২] আয়াত:ল-‘হ্কাল ও পরকালের সফলতাঃv&w
eavv‡ãi 11B GwcÖj gywReG‡mmi‡`i gvgjv wePvi Kivi †h c×wZ Pvjy Kiv n‡qwQj, cvwK¯Ív‡b mvgwiK &
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿قَدۡ أَفۡلَحَ مَن تَزَكَّىٰ ١٤ وَذَكَرَ ٱسۡمَ رَبِّهِۦ فَصَلَّىٰ ١٥﴾ [الاعلا: ١٤، ١٥]
“নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে যে পবিত্রতা অর্জন করে, এবং তার রবের নাম স্মরণ করে ও সালাত আদায় করে।” [সূরা আল-আ‘লা, আয়াত: ১৪-১৫]
আয়াতে উল্লিখিত “ফালাহ” শব্দটি এমন ব্যাপক যার অর্থ দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ বুঝায়।
৯। সালাতের মধ্যে রয়েছে রুযীর প্রশস্ততা: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَأۡمُرۡ أَهۡلَكَ بِٱلصَّلَوٰةِ وَٱصۡطَبِرۡ عَلَيۡهَاۖ لَا نَسَۡٔلُكَ رِزۡقٗاۖ نَّحۡنُ نَرۡزُقُكَۗ وَٱلۡعَٰقِبَةُ لِلتَّقۡوَىٰ ١٣٢﴾ [طه: ١٣٢]
“এবং তোমার পরিবারবর্গকে সালাতের আদেশ দাও আর তাতে অবিচল থাক, আমরা তোমার নিকট কোনো রুযী চাই না, আমরাই তোমাকে রুযী দেই এবং শুভ পরিণাম তো তাকওয়াধারীদের জন্য।” [সূরা ত্বাহা, আয়াত: ১৩২]
ইবন কাসীর রহ. এই আয়াতের তাফসীরে বলেন, “অর্থাৎ যদি সালাত প্রতিষ্ঠা কর এমনভাবে তোমার নিকট রুযী আসবে যার তুমি ধারণাও করতে পারবে না।”
১০। সালাত আত্মার যাকাত, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা: সালাত অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে বাঁচার এক দুর্ভেদ্য দূর্গ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱتۡلُ مَآ أُوحِيَ إِلَيۡكَ مِنَ ٱلۡكِتَٰبِ وَأَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَۖ إِنَّ ٱلصَّلَوٰةَ تَنۡهَىٰ عَنِ ٱلۡفَحۡشَآءِ وَٱلۡمُنكَرِ﴾ [العنكبوت: ٤٥]
“তুমি পাঠ কর কিতাব থেকে যা তোমার প্রতি ওহী করা হয়েছে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা কর, সালাত অবশ্যই অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে।” [সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ৪৫]
অর্থাৎ সালাত সংরক্ষণকারী এবং গুরুত্ব দানকারী নিজের মধ্যে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি অনুভব করবে এবং সে অতিসত্বর অশ্লীল ও মন্দ আচরণ থেকে বিরত থাকবে। এ জন্য পিতা-মাতার জরুরি কর্তব্য হলো, তারা যেন সন্তানদেরকে বাল্যাবস্থাতেই সালাতের প্রতি আগ্রহের পূর্ণ প্রশিক্ষণ দেয়, তারা যেন মন্দ-অশ্লীলতা ও খারাপ নেশায় আসক্ত না হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্তানের পিতা-মাতাকে এরই ওসীয়ত করেন এবং বলেন, “যখন তোমাদের সন্তান সাত বছরের হয় তখন তাদেরকে সালাতের আদেশ কর এবং যখন তারা দশ বছরে উপনীত হবে, তখন তাদেরকে সালাতের জন্য (ত্যাগ করলে) প্রহার কর এবং তাদের বিছানা আলাদা করে দাও”। (সুনান আবু দাউদ)
১১। সালাত ইহকাল ও পরকালে মুমিনদের জন্য দৃঢ়তা ও স্থিরতা আনে: অতএব, সালাত আদায়কারীর যখন সুখ আসে তখন সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আর তা তার জন্য উত্তম এবং যখন কোনো বিপদ দেখা দেয় তখন ধৈর্য ধারণ করে, সেটাও তার জন্য কল্যাণকর। কিন্তু বেনামাযীর অবস্থা এর বিপরীত। উক্ত অবস্থায় সে হা-হুতাশ ও অতি কৃপণতা শুরু করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ ٱلۡإِنسَٰنَ خُلِقَ هَلُوعًا ١٩ إِذَا مَسَّهُ ٱلشَّرُّ جَزُوعٗا ٢٠ وَإِذَا مَسَّهُ ٱلۡخَيۡرُ مَنُوعًا ٢١ إِلَّا ٱلۡمُصَلِّينَ ٢٢ ٱلَّذِينَ هُمۡ عَلَىٰ صَلَاتِهِمۡ دَآئِمُونَ ٢٣﴾ [المعارج: ١٩، ٢٣]
“মানুষ তো সৃজিত হয়েছে অতিশয় অস্থিরচিত্ত রূপে। যখন বিপদ তাকে স্পর্শ করে তখন সে হা-হুতাশ করে। আর যখন কল্যাণ তাকে স্পর্শ করে, সে অতি কৃপণ হয়। তবে সালাত আদায়কারী ব্যতীত। যারা তাদের সালাতে সদা প্রতিষ্ঠিত।” [সূরা আল-মা‘আরিজ, আয়াত: ১৯-২৩]
১২। সালাত বান্দার জন্য ইহকাল ও পরকালে হিফাযত ও নিরাপত্তামূলক: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَنْ صَلَّى الصُّبْحَ فَهُوَ فِي ذِمَّةِ اللَّهِ، فَلَا تُخْفِرُوا اللَّهَ فِي عَهْدِهِ، فَمَنْ قَتَلَهُ طَلَبَهُ اللَّهُ حَتَّى يَكُبَّهُ فِي النَّارِ، عَلَى وَجْهِهِ»
যে ব্যক্তি সকালের (ফজরের) সালাত আদায় করল সে আল্লাহর জিম্মায় (নিরাপত্তায়), কেউ যেন আল্লাহর এ জিম্মাদারী নষ্ট না করে। যে কেউ তাকে হত্যা করবে, আল্লাহ তাকে পাকড়াও করবেন এবং তাকে আল্লাহ তাকে জাহান্নামে অধোমুখে নিক্ষেপ করবেন।” (সহীহ মুসলিম)
১৩। সালাত আদায়ের ফলে আল্লাহ তা‘আলার ভালবাসা অর্জন হয়: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَٱللَّهُ يُحِبُّ ٱلۡمُطَّهِّرِينَ﴾ [التوبة: ١٠٨]
“আল্লাহ বেশি বেশি পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে পছন্দ করেন।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১০৮]
আর সালাত আদায়কারী ব্যক্তি পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত। কেননা পবিত্রতা অর্জন করা সালাত শুদ্ধ হওয়ার জন্য একটি শর্ত।
উত্তরঃ প্রিয় পাঠক! আল্লাহ তা‘আলার বাণীর প্রতি লক্ষ্য করুন:
﴿فَوَيۡلٞ لِّلۡمُصَلِّينَ ٤ ٱلَّذِينَ هُمۡ عَن صَلَاتِهِمۡ سَاهُونَ ٥﴾ [الماعون: ٤، ٥]
“সুতরাং দুর্ভোগ (‘ওয়াইল’ জাহান্নামের একটি স্থান) সেই সালাত আদায়কারীদের যারা তাদের সালাত সম্পর্কে উদাসীন।” [সূরা আল-মাউন, আয়াত: ৪-৫]
তাফসীরকারকগণ এই আয়াতের তাফসীর করেন যে, এই আয়াত দ্বারা ঐ সমস্ত লোক বুঝায়, যারা সালাতকে তার সময় থেকে পিছিয়ে অসময়ে আদায় করে। সা‘দ ইবন আবী ওয়াক্কাস থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ٱلَّذِينَ هُمۡ عَن صَلَاتِهِمۡ سَاهُونَ আয়াতটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তর দেন “এরা ঐ সমস্ত মানুষ যারা সালাতকে তার (প্রকৃত) সময়ে আদায় না করে পরে আদায় করে”। (তাফসীর ইবন কাসীর)
আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে মুসল্লী (সালাত আদায়কারী) নামে অভিহিত করা সত্ত্বেও তাদেরকে ওয়াইলের হুশিয়ারী দিয়েছেন। কেননা তারা সালাত প্রকৃত সময়ের পরে আদায় করে। অতএব, সালাতকে আপন ওয়াক্ত থেকে পরে আদায় করার জন্য আল্লাহ যাদেরকে ওয়াইলের হুশিয়ারী দিয়েছেন, তারা কীভাবে উপরোক্ত উপকারিতা ও ফযীলতের অধিকারী হবে?
সুতরাং সালাতের জন্য রয়েছে নির্ধারিত ওয়াক্ত। শর‘ঈ ওযর ব্যতীত নির্ধারিত ওয়াক্ত নষ্ট করা যাবে না। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ ٱلصَّلَوٰةَ كَانَتۡ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ كِتَٰبٗا مَّوۡقُوتٗا﴾ [النساء: ١٠٣]
“নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায় করা মুমিনদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০৩]
ইবন কাসীর রহ. তার তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেন: “ইবন আব্বাস “মাওকূতান” এর তাফসীরে ফরয অর্থ নিয়েছেন”। তিনি আরো উল্লেখ করেন: “হজের মতো সালাতেরও সময় নির্ধারিত”। অতঃপর তিনি বর্ণনা করেন: “ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হজের মতো সালাতেরও একটি নির্ধারিত সময় রয়েছে”।
প্রিয় পাঠক! (আপনার প্রতি আল্লাহ রহম করুন) সাহাবীগণের যুগের তাফসীরের ইমামদের প্রতি লক্ষ্য করুন। ইবন মাসউদ ও ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা কীভাবে হজের মতো সালাতেরও এক নির্ধারিত সময় সাব্যস্ত করেছেন। আর কে আছে এমন যে হজ নির্ধারিত সময়ে আদায় না করে তা অসময়ে আদায় করবে? সালাতেরও সময় এমনি নির্ধারিত, কোনো শর‘ঈ ওযর ব্যতীত নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায় না করলে আল্লাহ কবুল করবেন না।
সম্মানিত পাঠক! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীর প্রতি লক্ষ্য করুন: “যে ব্যক্তি সালাতের হিফাযত করল, সালাত তার জন্য কিয়ামতের দিন জ্যোতি, দলীল-প্রমাণ ও নাযাতের উসীলা হবে। আর যে ব্যক্তি সালাতের হিফাযত করল না, তার জন্য সালাত কিয়ামতের দিন জ্যোতি, প্রমাণ ও নাযাতের উসীলা হবে না, বরং কারূন, ফিরআউন, হামান এবং উবাই ইবন খালাফের সাথে তার হাশর (পুনরুত্থান) হবে”। (মুসনাদে আহমদ)
আর যে ব্যক্তি সালাত ঠিক সময়ে আদায় করল না, সে সালাতের হিফাযতও করল না।
অতএব, সালাত নির্ধারিত সময়ে আদায়ে তৎপর হোন ও এর প্রতি গুরুত্ব দিন। সালাতের নিয়ম-কানূন শিখার প্রতিও তেমনি তৎপর হউন, কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«صلوا كما رأيتموني أصلى»
“তোমরা সেভাবে সালাত পড় যেভাবে আমাকে সালাত পড়তে দেখ।” (সহীহ বুখারী)
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে প্রবেশ করলেন। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি প্রবেশ করল ও সালাত আদায় করল তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে সালাম দিল। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ফিরে যাও পুনরায় সালাত আদায় কর, কেননা তুমি সালাতই আদায় কর নি। সে তিনবার একইভাবে আদায় করল।” নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই লোকটির ওপর বিধান আরোপ করলেন যে, সে সালাতই আদায় করে নি শুধু তার সালাতে স্থিরতা না থাকার কারণে। আর এ জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে শিক্ষা দিয়ে দিলেন সালাত কীভাবে আদায় করতে হয়।
অতএব, আমরা পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ ফলাফলে পৌঁছতে পারি যে, সালাত অবশ্যই যথাসময়ে আদায় করতে হবে এবং তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাতেরই অনুরূপ হতে হবে। তবেই ইনশাআল্লাহ উক্ত সালাত গ্রহণযোগ্য ও উপকারী হবে এবং দুনিয়াতেও তার ফল প্রকাশিত হবে।
উত্তরঃ প্রিয় পাঠক! লক্ষ্য করুন নিম্নে বর্ণিত ঘটনার প্রতি, ঘটনাটি বর্ণনা করেন ইমাম আহমদ রহ. তার কিতাবুস সালাতে। যার মূল বর্ণনা রয়েছে সহীহ মুসলিমে। ইমাম আহমাদ বলেন, “আব্দুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে; সে বলল হে আল্লাহর রাসূল, আমি একজন দৃষ্টি শক্তিহীন, দুর্বল শরীর এবং বৃদ্ধ মানুষ, বাড়ীও দূরে, মসজিদ ও আমার মাঝে খেজুর গাছ এবং খালও রয়েছে। অতএব, আমি বাড়ীতেই সালাত আদায় করব এই অনুমতি কি রয়েছে?” নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন: “তুমি কি আযান শুন?” সে বলল জি হ্যাঁ, তিনি বললেন: “তবে মসজিদে আসতে হবে।”
ইমাম আহমদ উল্লিখিত হাদীস বর্ণনা শেষে বলেন, “যদি কারো জন্য সালাতের জামা‘আত থেকে বিরত থাকার সুযোগ থাকতো তবে অবশ্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বৃদ্ধ, দুর্বল শরীর, দৃষ্টি শক্তিহীন, বাড়ী দূরে অবস্থিত এবং তার ও মসজিদের মাঝে অনেক খেজুর গাছ ও খাল বিদ্যমান ব্যক্তিটিকে অনুমতি দিতেন। (ইমাম আহমদের উক্তি এ পর্যন্ত)
অতএব, এই স্পষ্ট সহীহ হাদীস জানার পর কি আর কারো জন্য সালাতের জামা‘আত থেকে বিরত থাকার কোনো সুযোগ রয়েছে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি এ ব্যক্তির ওযর গ্রহণও করতেন তবুও কোনো সুস্থ-সবল ও দৃষ্টি শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য জামা‘আত থেকে বিরত থাকার ওযর গ্রহণযোগ্য হতো না। দেখুন! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে তার ওযর প্রত্যাখ্যান করে তাকে মসজিদের জামাতে শরীক হওয়ার নির্দেশ দিলেন, আর তাঁর নির্দেশ দ্বারা ওয়াজিব সাব্যস্ত হয়।
দ্বিতীয় দলীল: মসজিদে জামা‘আতবদ্ধভাবে সালাত আদায় ওয়াজিব হওয়ার দ্বিতীয় দলীল হলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীঃ “যে ব্যক্তি আযান শুনল অতঃপর শর‘ঈ ওযর ব্যতীত মসজিদে উপস্থিত হলো না তার সালাত হবে না।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবন মাজাহ)
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, শর‘ঈ ওযর কী? তিনি বলেন, ভয়-ভীতি অথবা অসুস্থতা।
তৃতীয় দলীল: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: শপথ ঐ সত্তার যার হাতে রয়েছে আমার প্রাণ, আমি ইচ্ছা পোষণ করছি যে, কাঠ (জ্বালানী) একত্রিত করার আদেশ দিব এবং এক ব্যক্তিকে আদেশ দিব সে যেন সালাতের ইমামতী করে অতঃপর (যে মসজিদে আসে নি) আমি ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের নিকট গিয়ে তাদের বাড়ী-ঘর জ্বালিয়ে দেই।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
ইমাম আহমদ “কিতাবুস সালাত”-এ বলেন, তাদের সালাত থেকে বিরত থাকা যদি বড় গুনাহ্ না হতো, তবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার হুশিয়ারী দিতেন না।
চতুর্থ দলীল: ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি চায় যে সে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার সাথে মুসলিম অবস্থায় সাক্ষাৎ করে আনন্দ উপভোগ করবে, সে যেন সালাতসমূহের হিফাযত করে যেখানেই সালাতের আযান দেওয়া হোক না কেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের নবীর জন্য হিদায়াতের বিধিসম্মত পথ নির্ণয় করেছেন। আর সালাতসমূহ ঐ বিধিসম্মত পথেরই অন্তর্ভুক্ত, তোমরা যদি নিজেদের ঘরে-ঘরে সালাত পড়া শুরু কর যেমন, (জামা‘আত থেকে) বিরত এ ব্যক্তিটি নিজের ঘরে সালাত আদায় করে থাকে, তাহলে তোমরা তোমাদের নবীর সুন্নাতকে পরিত্যাগ করলে, আর যদি তোমাদের নবীর সুন্নাত পরিত্যাগ কর তবে অবশ্যই পথভ্রষ্ট হবে। আর আমরা তো আমাদের যুগে দেখতাম, সালাতের জামা‘আত থেকে মুনাফিক ব্যক্তিই বিরত থাকত, যাদের মুনাফেকী স্পষ্ট। (আমাদের মাঝে এমন) এক ব্যক্তিও ছিল যাকে দু’জনের উপর ভর করে নিয়ে এসে (সালাতের) কাতারে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হত। (সহীহ মুসলিম)
ইবন মাসউদের অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে- তিনি বলেন, “নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে হিদায়াতের তরীকা শিখিয়ে দিয়েছেন এবং হিদায়াতের তরীকাসমূহের অন্যতম হলো যে মসজিদে আযান দেওয়া হয় সেখানেই সালাত আদায় করা।”
হিবরুল উম্মাহ (উম্মাতের পণ্ডিত ব্যক্তি) আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই বাণীর প্রতি লক্ষ্য করুন, যার মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয় ফুটে উঠে:
১। (ফরয) সালাত বাড়ীতে আদায় করা হলো সুন্নাত তথা রাসূলের আদর্শ পরিহার করা। আর রাসূলের আদর্শ পরিহার করা হলো পথভ্রষ্টতা।
২। সাহাবায়ে কিরাম সালাতের জামা‘আত থেকে বিরত ব্যক্তিদেরকে সু-স্পষ্ট মুনাফিক গণনা করতেন; যার মুনাফেকীতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
৩। সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমের সালাতের জামা‘আতের প্রতি গুরুত্ব, এমন কি (তাদের মধ্যে) অসুস্থ ব্যক্তি যিনি চলতে পারেন না, তাকেও দু’জনের উপর ভর দিয়ে নিয়ে আসা হতো।
প্রিয় দীনী ভাই! সালাত জামা‘আতের সাথে আদায় ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে বর্ণিত এই সমস্ত স্পষ্ট প্রমাণ-পঞ্জি এবং এছাড়াও অসংখ্য দলীল প্রমাণের পর সালাত জামা‘আতের সাথে আদায়ে বিরত ব্যক্তিদের জন্য অলসতা, প্রবৃত্তির অনুসরণ এবং শয়তানের প্রতিবন্ধকতা ব্যতীত আর কোনো ওযর-আপত্তি অবশিষ্ট থাকে না। আল্লাহ আমাদেরকে এ থেকে রক্ষা করুন।
এ বিষয়টিকে হিবরুল উম্মাহ, কুরআনের ভাষ্যকর আব্দুল্লাহ্ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর ফাতওয়ার মাধ্যমে শেষ করতে চাই যা তিরমিযীতে প্রখ্যাত তাবে‘ঈ মুজাহিদ থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, ইবন আব্বাসকে এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, যে দিনে সাওম রাখে এবং রাত্রিতে ইবাদতে মগ্ন থাকে কিন্তু জুমু‘আ ও জামা‘আতের সালাতে উপস্থিত হয় না, তিনি বলেন, সে জাহান্নামী।”
অতএব, জাহান্নামী হওয়ার ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তির কী হবে, যে ব্যক্তি রাত্রি জাগরণ করে আল্লাহ কর্তৃক হারাম জিনিসে মত্ত থাকে? যেমন টিভি, সিরিজ (ভি ডি ও, ডিশ) ইত্যাদি এবং দিনে ফজর ও অন্যান্য সালাত আদায় না করে ঘুমায়?
দীনি ভাই! এই ব্যাপারটি অত্যন্ত ভয়াবহ, সালাতের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর। কেননা সালাতই হচ্ছে জান্নাত নতুবা জাহান্নাম। আল্লাহ আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করুন।”
www.atowar-rahman-salafi.blogspot.com
Comments
Post a Comment