ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল: Monthly at tahrek
ছওম বা ছিয়াম : অর্থ বিরত থাকা। শরী‘আতের পরিভাষায় আল্ললাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ছুবহে ছাদিক হ’তে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌন সম্ভোগ হ’তে বিরত থাকাকে ‘ছওম’ বা ‘ছিয়াম’ বলা হয়। ২য় হিজরী সনে ছিয়াম ফরয হয়।
ছিয়ামের ফাযায়েল : রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় রামাযানের ছিয়াম পালন করে, তার বিগত সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়’।[1]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরও বলেন, ‘আদম সন্তানের প্রত্যেক নেক আমলের ছওয়াব দশগুণ হ’তে সাতশত গুণ পর্যন্ত প্রদান করা হয়। আল্লাহ বলেন, কিন্তু ছওম ব্যতীত। কেননা ছওম কেবল আমার জন্যই (রাখা হয়) এবং আমিই তার পুরস্কার প্রদান করব। সে তার যৌনাকাঙ্খা ও পানাহার কেবল আমার জন্যই পরিত্যাগ করে। ছিয়াম পালনকারীর জন্য দু’টি আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি ইফতারকালে, অন্যটি তার প্রভুর সাথে দীদারকালে। তার মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকটে মিশকের খোশবুর চেয়েও সুগন্ধিময়। ছিয়াম (অন্যায় অপকর্মের বিরুদ্ধে) ঢাল স্বরূপ। অতএব যখন তোমরা ছিয়াম পালন করবে, তখন মন্দ কথা বলবে না ও বাজে বকবে না। যদি কেউ গালি দেয় বা লড়াই করতে আসে তখন বলবে, আমি ছায়েম’।[2]
মাসায়েল :
১. ছিয়ামের নিয়ত : নিয়ত অর্থ- মনন করা বা সংকল্প করা। অতএব মনে মনে ছিয়ামের সংকল্প করাই যথেষ্ট। হজ্জের তালবিয়া ব্যতীত ছালাত, ছিয়াম বা অন্য কোন ইবাদতের শুরুতে আরবী বা অন্য ভাষায় নিয়ত পড়া বিদ‘আত।
২. ইফতারের দো‘আ : ‘বিসমিল্ললাহ’ বলে শুরু ও ‘আলহামদুলিল্ললাহ’ বলে শেষ করবে।[3] ইফতারের দো‘আ হিসাবে প্রসিদ্ধ আল্ললাহুম্মা লাকা ছুমতু... হাদীছটি ‘যঈফ’। ইফতার শেষে নিম্নোক্ত দো‘আ পড়া যাবে- ‘যাহাবায যামাউ ওয়াবতাল্ললাতিল উরূকু ওয়া ছাবাতাল আজরু ইনশাআল্ললাহ’ (পিপাসা দূরীভূত হ’ল ও শিরাগুলি সঞ্জীবিত হ’ল এবং আল্ললাহ চাহেন তো পুরস্কার ওয়াজিব হ’ল)।[4]
৩. রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) বলেন, দ্বীন চিরদিন বিজয়ী থাকবে, যতদিন লোকেরা ইফতার দ্রুত করবে। কেননা ইহূদী-নাছারাগণ ইফতার দেরীতে করে’।[5] তিনি বলেন, তোমরা ইফতার দ্রুত কর এবং সাহারী দেরীতে কর।[6] তিনি আরো বলেন, ‘আহলে কিতাবদের সাথে আমাদের ছিয়ামের পার্থক্য হ’ল সাহারী খাওয়া’।[7]
৪. সাহারীর আযান : রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ)-এর যামানায় তাহাজ্জুদ ও সাহারীর আযান বেলাল (রাঃ) দিতেন এবং ফজরের আযান অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্ললাহ ইবনু উম্মে মাকতূম (রাঃ) দিতেন। রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) বলেন, ‘বেলাল রাত্রে আযান দিলে তোমরা খানাপিনা কর, যতক্ষণ না ইবনু উম্মে মাকতূম ফজরের আযান দেয়’।[8] বুখারীর ভাষ্যকার হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘বর্তমান কালে সাহারীর সময় লোক জাগানোর নামে আযান ব্যতীত যা কিছু করা হয় সবই বিদ‘আত’।[9]
৫. রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘খাদ্য বা পানির পাত্র হাতে থাকা অবস্থায় তোমাদের মধ্যে যদি কেউ ফজরের আযান শোনে, তবে সে যেন প্রয়োজন পূর্ণ না করে পাত্র রেখে না দেয়’।[10]
৬. তারাবীহর ছালাতের ফযীলত : রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রামাযানের রাত্রিতে ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রাত্রির ছালাত আদায় করে, তার বিগত সকল গোনাহ মাফ করা হয়’।[11]
৭. তারাবীহর রাক‘আত সংখ্যা : (ক) হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) রামাযান বা রামাযানের বাইরে (তিন রাক‘আত বিতরসহ) এগার রাক‘আতের বেশী রাতের নফল ছালাত আদায় করতেন না’।[12]
(খ) হযরত সায়েব বিন ইয়াযীদ (রাঃ) বলেন, ‘ওমর ফারূক (রাঃ) উবাই ইবনু কা‘ব ও তামীম আদ-দারী (রাঃ)-কে রামাযানের রাত্রিতে লোকদেরকে সাথে নিয়ে জামা‘আত সহকারে এগারো রাক‘আত ছালাত আদায়ের নির্দেশ দান করেন’।[13] এ সময় তাঁরা প্রথম রাত্রিতে ইবাদত করতেন।[14] শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, মুওয়াত্ত্বায় (হা/৩৮০) ইয়াযীদ বিন রূমান কর্তৃক যে বর্ণনাটি এসেছে যে, ‘লোকেরা ওমর ফারূক (রাঃ)-এর যামানায় ২৩ রাক‘আত তারাবীহ পড়ত’ একথাটি ‘যঈফ’। কেননা ইয়াযীদ বিন রূমান ওমর (রাঃ)-এর যামানা পাননি।[15] অতএব ইজমায়ে ছাহাবা কর্তৃক ওমর, ওছমান ও আলীর যামানা থেকে ২০ রাক‘আত তারাবীহ সাব্যস্ত বলে যে কথা চালু রয়েছে, তার কোন শারঈ ভিত্তি নেই। একথাটি ‘মুদরাজ’ বা পরবর্তীকালে অনুপ্রবিষ্ট। এতদ্ব্যতীত চার খলীফার কারো থেকেই ছহীহ সনদে ২০ রাক‘আত তারাবীহ প্রমাণিত নয়।[16] বিশ রাক‘আত তারাবীহ-এর প্রমাণে বর্ণিত হাদীছটি জাল।[17]
(গ) জামা‘আতের সাথে রাতের ছালাত (তারাবীহ) আদায় করা রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত এবং দৈনিক নিয়মিত জামা‘আতে আদায় করা ‘ইজমায়ে ছাহাবা’ হিসাবে প্রমাণিত।[18] অতএব তা বিদ‘আত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
৮. লায়লাতুল ক্বদরের দো‘আ : ‘আল্ললা-হুম্মা ইন্নাকা ‘আফুবুন তুহিববুল ‘আফওয়া ফা‘ফু ‘আন্নী’। অর্থ-‘হে আল্ললাহ! তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা পসন্দ কর, অতএব আমাকে তুমি ক্ষমা কর’।[19]
৯. ই‘তিকাফ : ই‘তিকাফ তাক্বওয়া অর্জন করার একটি বড় মাধ্যম। এতে লায়লাতুল ক্বদর অনুসন্ধানের সুযোগ হয়। রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) মসজিদে নববীতে রামাযানের শেষ দশকে নিয়মিত ই‘তিকাফ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রীগণও ই‘তিকাফ করেছেন’।[20] নারীদের জন্য বাড়ীর নিকটস্থ মসজিদে ই‘তিকাফ করা উত্তম।[21]
২০শে রামাযান সূর্যাস্তের পূর্বে ই‘তিকাফ স্থলে প্রবেশ করবে এবং ঈদের আগের দিন বাদ মাগরিব বের হবে।[22] তবে বাধ্যগত কারণে শেষ দশদিনের সময়ে আগপিছ করা যাবে। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া ই‘তিকাফকারী নিজ বাড়ীতে প্রবেশ করবে না।[23]
১০. ফিৎরা : (ক) ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) স্বীয় উম্মতের ক্রীতদাস ও স্বাধীন, পুরুষ ও নারী, ছোট ও বড় সকলের উপর মাথাপিছু এক ছা‘ খেজুর, যব ইত্যাদি (অন্য বর্ণনায়) খাদ্যবস্ত্ত ফিৎরার যাকাত হিসাবে ফরয করেছেন এবং তা ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই আমাদেরকে আদায়ের নির্দেশ দান করেছেন’।[24] ঈদুল ফিতরের ১ বা ২ দিন আগে বায়তুল মাল জমাকারীর নিকট ফিৎরা জমা করা সুন্নাত, যা ঈদের পরে হকদারগণের মধ্যে বণ্টন করতে হবে।[25]
(খ) রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ)-এর যুগে মদীনায় ‘গম’ ছিল না। মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর যুগে সিরিয়ার গম মদীনায় আমদানী হ’লে উচ্চ মূল্যের বিবেচনায় তিনি গমে অর্ধ ছা‘ ফিৎরা দিতে বলেন। কিন্তু ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরীসহ অন্যান্য ছাহাবীগণ মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর এই ইজতিহাদী সিদ্ধান্ত অমান্য করেন এবং রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশ ও প্রথম যুগের আমলের উপরেই কায়েম থাকেন। ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, ‘যারা অর্ধ ছা‘ গমের ফিৎরা দেন, তারা মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর ‘রায়’-এর অনুসরণ করেন মাত্র’।[26] (গ) মদীনার হিসাবে এক ছা‘ এদেশের আড়াই কেজি চাউলের সমান অথবা প্রমাণ সাইজ হাতের পূর্ণ চার অঞ্জলী চাউল। টাকা দিয়ে ফিৎরা আদায় করার কোন দলীল নেই।
১১. ঈদের তাকবীর : ছালাতুল ঈদায়েনে প্রথম রাক‘আতে সাত, দ্বিতীয় রাক‘আতে পাঁচ মোট ১২ তাকবীর দেওয়া সুন্নাত।[27] ছহীহ বা যঈফ সনদে ৬ (ছয়) তাকবীরের পক্ষে রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) হ’তে কোন হাদীছ নেই।[28]
১২. মহিলাদের ঈদের জামা‘আত : মহিলাগণ শারঈ পর্দা বজায় রেখে পুরুষদের ঈদের জামা‘আতে শরীক হ’তে পারবেন। উম্মে ‘আতিয়া (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) আমাদেব ঋতুবতী এবং বিবাহিতা ও অবিবাহিতা মহিলাদের ঈদগাহে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে ঋতুবতী মহিলারা ঈদগাহে মুসলমানদের জামা‘আতে ও তাদের দো‘আতে শরীক হবে। কিন্তু ছালাত আদায় থেকে বিরত থাকবে।[29]
১৩. ছিয়াম ভঙ্গের কারণ সমূহ : (ক) ছিয়াম অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে খানাপিনা করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় এবং তার কাযা ওয়াজিব হয়। (খ) যৌনসম্ভোগ করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় এবং তার কাফফারা স্বরূপ একটানা দু’মাস ছিয়াম পালন অথবা ৬০ (ষাট) জন মিসকীন খাওয়াতে হয় (নিসা ৯২; মুজাদালাহ ৪)। (গ) ছিয়াম অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে ক্বাযা আদায় করতে হবে। তবে অনিচ্ছাকৃত বমি হ’লে, ভুলক্রমে কিছু খেলে বা পান করলে, স্বপ্নদোষ বা সহবাসজনিত নাপাকী অবস্থায় সকাল হয়ে গেলে, চোখে সুর্মা লাগালে বা মিসওয়াক করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় না।[30]
১৪. ছিয়ামের অন্যান্য বিধান : (ক) অতি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা অসুস্থ তথা যারা ছিয়াম পালনে অক্ষম, তারা ছিয়ামের ফিদইয়া হিসাবে দৈনিক একজন করে মিসকীন খাওয়াবেন (বাক্বারাহ ২/১৮৪)। ছাহাবী আনাস (রাঃ) গোশত-রুটি বানিয়ে একদিনে ৩০ (ত্রিশ) জন মিসকীন খাইয়েছিলেন।[31] ইবনু আববাস (রাঃ) গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিণী মহিলাদেরকে ছিয়ামের ফিদইয়া আদায় করতে বলতেন।[32] (খ) মৃত ব্যক্তির ছিয়ামের ক্বাযা তার উত্তরাধিকারীগণ আদায় করবেন অথবা তার বিনিময়ে ফিদইয়া দিবেন।[33] ফিদইয়ার পরিমাণ দৈনিক এক মুদ বা সিকি ছা‘ চাউল অথবা গম।[34] তবে বেশী দিলে বেশী নেকী পাবেন (বাক্বারাহ ২/১৮৪)।
[1]. বুখারী হা/৩৮; মুসলিম হা/৭৬০; মিশকাত হা/১৯৫৮।
[2]. বুখারী হা/১৯০৪; মুসলিম হা/১১৫১; মিশকাত হা/১৯৫৯।
[3]. বুখারী, মিশকাত হা/৪১৯৯; মুসলিম, ঐ, হা/৪২০০।
[4]. আবুদাঊদ হা/২৩৫৭-২৩৫৮; মিশকাত হা/১৯৯৩-৯৪।
[5]. আবুদাউদ হা/২৩৫৩; মিশকাত হা/১৯৯৫।
[6]. ত্বাবারাণী, ছহীহুল জামে‘ হা/৩৯৮৯।
ছওম বা ছিয়াম : অর্থ বিরত থাকা। শরী‘আতের পরিভাষায় আল্ললাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ছুবহে ছাদিক হ’তে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌন সম্ভোগ হ’তে বিরত থাকাকে ‘ছওম’ বা ‘ছিয়াম’ বলা হয়। ২য় হিজরী সনে ছিয়াম ফরয হয়।
ছিয়ামের ফাযায়েল : রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় রামাযানের ছিয়াম পালন করে, তার বিগত সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়’।[1]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরও বলেন, ‘আদম সন্তানের প্রত্যেক নেক আমলের ছওয়াব দশগুণ হ’তে সাতশত গুণ পর্যন্ত প্রদান করা হয়। আল্লাহ বলেন, কিন্তু ছওম ব্যতীত। কেননা ছওম কেবল আমার জন্যই (রাখা হয়) এবং আমিই তার পুরস্কার প্রদান করব। সে তার যৌনাকাঙ্খা ও পানাহার কেবল আমার জন্যই পরিত্যাগ করে। ছিয়াম পালনকারীর জন্য দু’টি আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি ইফতারকালে, অন্যটি তার প্রভুর সাথে দীদারকালে। তার মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকটে মিশকের খোশবুর চেয়েও সুগন্ধিময়। ছিয়াম (অন্যায় অপকর্মের বিরুদ্ধে) ঢাল স্বরূপ। অতএব যখন তোমরা ছিয়াম পালন করবে, তখন মন্দ কথা বলবে না ও বাজে বকবে না। যদি কেউ গালি দেয় বা লড়াই করতে আসে তখন বলবে, আমি ছায়েম’।[2]
মাসায়েল :
১. ছিয়ামের নিয়ত : নিয়ত অর্থ- মনন করা বা সংকল্প করা। অতএব মনে মনে ছিয়ামের সংকল্প করাই যথেষ্ট। হজ্জের তালবিয়া ব্যতীত ছালাত, ছিয়াম বা অন্য কোন ইবাদতের শুরুতে আরবী বা অন্য ভাষায় নিয়ত পড়া বিদ‘আত।
২. ইফতারের দো‘আ : ‘বিসমিল্ললাহ’ বলে শুরু ও ‘আলহামদুলিল্ললাহ’ বলে শেষ করবে।[3] ইফতারের দো‘আ হিসাবে প্রসিদ্ধ আল্ললাহুম্মা লাকা ছুমতু... হাদীছটি ‘যঈফ’। ইফতার শেষে নিম্নোক্ত দো‘আ পড়া যাবে- ‘যাহাবায যামাউ ওয়াবতাল্ললাতিল উরূকু ওয়া ছাবাতাল আজরু ইনশাআল্ললাহ’ (পিপাসা দূরীভূত হ’ল ও শিরাগুলি সঞ্জীবিত হ’ল এবং আল্ললাহ চাহেন তো পুরস্কার ওয়াজিব হ’ল)।[4]
৩. রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) বলেন, দ্বীন চিরদিন বিজয়ী থাকবে, যতদিন লোকেরা ইফতার দ্রুত করবে। কেননা ইহূদী-নাছারাগণ ইফতার দেরীতে করে’।[5] তিনি বলেন, তোমরা ইফতার দ্রুত কর এবং সাহারী দেরীতে কর।[6] তিনি আরো বলেন, ‘আহলে কিতাবদের সাথে আমাদের ছিয়ামের পার্থক্য হ’ল সাহারী খাওয়া’।[7]
৪. সাহারীর আযান : রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ)-এর যামানায় তাহাজ্জুদ ও সাহারীর আযান বেলাল (রাঃ) দিতেন এবং ফজরের আযান অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্ললাহ ইবনু উম্মে মাকতূম (রাঃ) দিতেন। রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) বলেন, ‘বেলাল রাত্রে আযান দিলে তোমরা খানাপিনা কর, যতক্ষণ না ইবনু উম্মে মাকতূম ফজরের আযান দেয়’।[8] বুখারীর ভাষ্যকার হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘বর্তমান কালে সাহারীর সময় লোক জাগানোর নামে আযান ব্যতীত যা কিছু করা হয় সবই বিদ‘আত’।[9]
৫. রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘খাদ্য বা পানির পাত্র হাতে থাকা অবস্থায় তোমাদের মধ্যে যদি কেউ ফজরের আযান শোনে, তবে সে যেন প্রয়োজন পূর্ণ না করে পাত্র রেখে না দেয়’।[10]
৬. তারাবীহর ছালাতের ফযীলত : রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রামাযানের রাত্রিতে ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রাত্রির ছালাত আদায় করে, তার বিগত সকল গোনাহ মাফ করা হয়’।[11]
৭. তারাবীহর রাক‘আত সংখ্যা : (ক) হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) রামাযান বা রামাযানের বাইরে (তিন রাক‘আত বিতরসহ) এগার রাক‘আতের বেশী রাতের নফল ছালাত আদায় করতেন না’।[12]
(খ) হযরত সায়েব বিন ইয়াযীদ (রাঃ) বলেন, ‘ওমর ফারূক (রাঃ) উবাই ইবনু কা‘ব ও তামীম আদ-দারী (রাঃ)-কে রামাযানের রাত্রিতে লোকদেরকে সাথে নিয়ে জামা‘আত সহকারে এগারো রাক‘আত ছালাত আদায়ের নির্দেশ দান করেন’।[13] এ সময় তাঁরা প্রথম রাত্রিতে ইবাদত করতেন।[14] শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, মুওয়াত্ত্বায় (হা/৩৮০) ইয়াযীদ বিন রূমান কর্তৃক যে বর্ণনাটি এসেছে যে, ‘লোকেরা ওমর ফারূক (রাঃ)-এর যামানায় ২৩ রাক‘আত তারাবীহ পড়ত’ একথাটি ‘যঈফ’। কেননা ইয়াযীদ বিন রূমান ওমর (রাঃ)-এর যামানা পাননি।[15] অতএব ইজমায়ে ছাহাবা কর্তৃক ওমর, ওছমান ও আলীর যামানা থেকে ২০ রাক‘আত তারাবীহ সাব্যস্ত বলে যে কথা চালু রয়েছে, তার কোন শারঈ ভিত্তি নেই। একথাটি ‘মুদরাজ’ বা পরবর্তীকালে অনুপ্রবিষ্ট। এতদ্ব্যতীত চার খলীফার কারো থেকেই ছহীহ সনদে ২০ রাক‘আত তারাবীহ প্রমাণিত নয়।[16] বিশ রাক‘আত তারাবীহ-এর প্রমাণে বর্ণিত হাদীছটি জাল।[17]
(গ) জামা‘আতের সাথে রাতের ছালাত (তারাবীহ) আদায় করা রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত এবং দৈনিক নিয়মিত জামা‘আতে আদায় করা ‘ইজমায়ে ছাহাবা’ হিসাবে প্রমাণিত।[18] অতএব তা বিদ‘আত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
৮. লায়লাতুল ক্বদরের দো‘আ : ‘আল্ললা-হুম্মা ইন্নাকা ‘আফুবুন তুহিববুল ‘আফওয়া ফা‘ফু ‘আন্নী’। অর্থ-‘হে আল্ললাহ! তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা পসন্দ কর, অতএব আমাকে তুমি ক্ষমা কর’।[19]
৯. ই‘তিকাফ : ই‘তিকাফ তাক্বওয়া অর্জন করার একটি বড় মাধ্যম। এতে লায়লাতুল ক্বদর অনুসন্ধানের সুযোগ হয়। রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) মসজিদে নববীতে রামাযানের শেষ দশকে নিয়মিত ই‘তিকাফ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রীগণও ই‘তিকাফ করেছেন’।[20] নারীদের জন্য বাড়ীর নিকটস্থ মসজিদে ই‘তিকাফ করা উত্তম।[21]
২০শে রামাযান সূর্যাস্তের পূর্বে ই‘তিকাফ স্থলে প্রবেশ করবে এবং ঈদের আগের দিন বাদ মাগরিব বের হবে।[22] তবে বাধ্যগত কারণে শেষ দশদিনের সময়ে আগপিছ করা যাবে। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া ই‘তিকাফকারী নিজ বাড়ীতে প্রবেশ করবে না।[23]
১০. ফিৎরা : (ক) ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) স্বীয় উম্মতের ক্রীতদাস ও স্বাধীন, পুরুষ ও নারী, ছোট ও বড় সকলের উপর মাথাপিছু এক ছা‘ খেজুর, যব ইত্যাদি (অন্য বর্ণনায়) খাদ্যবস্ত্ত ফিৎরার যাকাত হিসাবে ফরয করেছেন এবং তা ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই আমাদেরকে আদায়ের নির্দেশ দান করেছেন’।[24] ঈদুল ফিতরের ১ বা ২ দিন আগে বায়তুল মাল জমাকারীর নিকট ফিৎরা জমা করা সুন্নাত, যা ঈদের পরে হকদারগণের মধ্যে বণ্টন করতে হবে।[25]
(খ) রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ)-এর যুগে মদীনায় ‘গম’ ছিল না। মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর যুগে সিরিয়ার গম মদীনায় আমদানী হ’লে উচ্চ মূল্যের বিবেচনায় তিনি গমে অর্ধ ছা‘ ফিৎরা দিতে বলেন। কিন্তু ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরীসহ অন্যান্য ছাহাবীগণ মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর এই ইজতিহাদী সিদ্ধান্ত অমান্য করেন এবং রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশ ও প্রথম যুগের আমলের উপরেই কায়েম থাকেন। ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, ‘যারা অর্ধ ছা‘ গমের ফিৎরা দেন, তারা মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর ‘রায়’-এর অনুসরণ করেন মাত্র’।[26] (গ) মদীনার হিসাবে এক ছা‘ এদেশের আড়াই কেজি চাউলের সমান অথবা প্রমাণ সাইজ হাতের পূর্ণ চার অঞ্জলী চাউল। টাকা দিয়ে ফিৎরা আদায় করার কোন দলীল নেই।
১১. ঈদের তাকবীর : ছালাতুল ঈদায়েনে প্রথম রাক‘আতে সাত, দ্বিতীয় রাক‘আতে পাঁচ মোট ১২ তাকবীর দেওয়া সুন্নাত।[27] ছহীহ বা যঈফ সনদে ৬ (ছয়) তাকবীরের পক্ষে রাসূলুল্ললাহ (ছাঃ) হ’তে কোন হাদীছ নেই।[28]
১২. মহিলাদের ঈদের জামা‘আত : মহিলাগণ শারঈ পর্দা বজায় রেখে পুরুষদের ঈদের জামা‘আতে শরীক হ’তে পারবেন। উম্মে ‘আতিয়া (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) আমাদেব ঋতুবতী এবং বিবাহিতা ও অবিবাহিতা মহিলাদের ঈদগাহে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে ঋতুবতী মহিলারা ঈদগাহে মুসলমানদের জামা‘আতে ও তাদের দো‘আতে শরীক হবে। কিন্তু ছালাত আদায় থেকে বিরত থাকবে।[29]
১৩. ছিয়াম ভঙ্গের কারণ সমূহ : (ক) ছিয়াম অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে খানাপিনা করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় এবং তার কাযা ওয়াজিব হয়। (খ) যৌনসম্ভোগ করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় এবং তার কাফফারা স্বরূপ একটানা দু’মাস ছিয়াম পালন অথবা ৬০ (ষাট) জন মিসকীন খাওয়াতে হয় (নিসা ৯২; মুজাদালাহ ৪)। (গ) ছিয়াম অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে ক্বাযা আদায় করতে হবে। তবে অনিচ্ছাকৃত বমি হ’লে, ভুলক্রমে কিছু খেলে বা পান করলে, স্বপ্নদোষ বা সহবাসজনিত নাপাকী অবস্থায় সকাল হয়ে গেলে, চোখে সুর্মা লাগালে বা মিসওয়াক করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় না।[30]
১৪. ছিয়ামের অন্যান্য বিধান : (ক) অতি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা অসুস্থ তথা যারা ছিয়াম পালনে অক্ষম, তারা ছিয়ামের ফিদইয়া হিসাবে দৈনিক একজন করে মিসকীন খাওয়াবেন (বাক্বারাহ ২/১৮৪)। ছাহাবী আনাস (রাঃ) গোশত-রুটি বানিয়ে একদিনে ৩০ (ত্রিশ) জন মিসকীন খাইয়েছিলেন।[31] ইবনু আববাস (রাঃ) গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিণী মহিলাদেরকে ছিয়ামের ফিদইয়া আদায় করতে বলতেন।[32] (খ) মৃত ব্যক্তির ছিয়ামের ক্বাযা তার উত্তরাধিকারীগণ আদায় করবেন অথবা তার বিনিময়ে ফিদইয়া দিবেন।[33] ফিদইয়ার পরিমাণ দৈনিক এক মুদ বা সিকি ছা‘ চাউল অথবা গম।[34] তবে বেশী দিলে বেশী নেকী পাবেন (বাক্বারাহ ২/১৮৪)।
[1]. বুখারী হা/৩৮; মুসলিম হা/৭৬০; মিশকাত হা/১৯৫৮।
[2]. বুখারী হা/১৯০৪; মুসলিম হা/১১৫১; মিশকাত হা/১৯৫৯।
[3]. বুখারী, মিশকাত হা/৪১৯৯; মুসলিম, ঐ, হা/৪২০০।
[4]. আবুদাঊদ হা/২৩৫৭-২৩৫৮; মিশকাত হা/১৯৯৩-৯৪।
[5]. আবুদাউদ হা/২৩৫৩; মিশকাত হা/১৯৯৫।
[6]. ত্বাবারাণী, ছহীহুল জামে‘ হা/৩৯৮৯।
[7]. মুসলিম হা/১০৯৬।
[8]. বুখারী হা/১৯১৯; মুসলিম হা/১০৯২; নায়লুল আওত্বার ২/১২০ পৃঃ।
[9]. ফাৎহুল বারী হা/৬২২-২৩-এর ব্যাখ্যা, ‘ফজরের পূর্বে আযান’ অনুচ্ছেদ ২/১২৩-২৪; নায়লুল আওত্বার ২/১১৯।
[10]. আবুদাউদ হা/২৩৫০, মিশকাত হা/১৯৮৮।
[11]. মুসলিম হা/৭৫৯; মিশকাত হা/১২৯৬।
[12]. বুখারী হা/১১৪৭; মুসলিম হা/৭৩৮; মিশকাত হা/১১৮৮।
[13]. মুওয়াত্ত্বা মালেক হা/৩৭৯, সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/১৩০২, ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘রামাযানে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ।
[14]. বুখারী, মিশকাত হা/১৩০১।
[15]. দ্রঃ আলবানী, মিশকাত, হা/১৩০২ টীকা-২।
[16]. হাশিয়া মুওয়াত্ত্বা পৃঃ ৭১-এর হাশিয়া-৭, ‘রামাযানে ছালাত’ অধ্যায়; দ্রঃ তুহফাতুল আহওয়াযী শরহ তিরমিয়ী হা/৮০৩-এর ব্যাখ্যা ৩/৫২৬-৩২।
[17]. আলবানী, ইরওয়াউল গালীল হা/৪৪৫, ২/১৯১ পৃঃ।
[18]. মিশকাত হা/১৩০২।
[19]. আহমাদ, ইবনু মাজাহ, তিরমিযী, মিশকাত হা/২০৯১।
[20]. বুখারী হা/২০২৬; মুসলিম হা/১১৭২; মিশকাত হা/২০৯৭।
[21]. ফাৎহুল বারী হা/২০৩৩-এর আলোচনা।
[22]. সাইয়িদ সাবিক্ব, ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৪৩৬ ‘ই‘তিকাফ স্থলে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময়’ অনুচ্ছেদ।
[23]. বুখারী হা/২০২৯।
[24]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, হা/১৮১৫, ১৮১৬।
[25]. বুখারী হা/১৫০৮-১২; ঐ দ্রঃ ফাৎহুল বারী, ৩/৪৩৬-৪১।
[26]. দ্রঃ ফাৎহুল বারী (কায়রো : ১৪০৭ হি), ৩/৪৩৮ পৃঃ।
[27]. আহমাদ, আবূদাঊদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৪৪১।
[28]. আলোচনা দ্রষ্টব্য : নায়লুল আওত্বার ৪/২৫৩-৫৬ পৃঃ; ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) পৃ. ২০৬-১২।
[29]. বুখারী হা/৯৮০-৯৮১; মুসলিম হা/৮৯০; মিশকাত হা/১৪৩১।
[30]. শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ৫/২৭১-৭৫, ২৮৩; ১/১৬২ পৃঃ।
[31]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ১৮৪ আয়াত।
[32]. বুখারী হা/৪৫০৫; ইরওয়া হা/৯১২; নায়ল ৫/৩১১ পৃঃ।
[33]. নায়ল ৫/৩১৫-১৭ পৃঃ।
[34]. বায়হাক্বী হা/৮০০৫-০৬, ৪/২৫৪ পৃঃ।
www.atowar-rahman-salafi.blogspot.com
Comments
Post a Comment