ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন বিদআত | Al Itisam


ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন বিদআত
-অধ্যাপক ওবায়দুল বারী* 

জন্মের সময়কাল’-কে আরবীতে ‘মীলাদ’ বা ‘মাওলিদ’ বলা হয়। সে হিসেবে ‘মীলাদুন্নবী’-এর অর্থ দাঁড়ায় ‘নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্মমুহূর্ত’। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্মের বিবরণ, কিছু ওয়ায ও নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রূহের আগমন কল্পনা করে তার সম্মানে উঠে দাঁড়িয়ে ‘ইয়া নাবী সালাম আলায়কা’ বলা ও সবশেষে জিলাপি বা মিষ্টান্ন বিতরণ করা— এই সব মিলিয়ে ‘মীলাদ মাহফিল’। ইসলাম প্রবর্তিত ‘ঈদুল ফিত্বর’ ও ‘ঈদুল আযহা’ নামের দুটি বার্ষিক উৎসব ছাড়াও মাযহাব ছদ্মবেশধারী এক শ্রেণির আলেম ভারত উপমহাদেশের ইসলামে তৃতীয় আরেকটি ধর্মীয় উত্সব সংযোজন করেন, যা ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ নামে পরিচিত।

বিদআতী ঈদে মীলাদুন্নবীর সূচনা যেভাবে হয় :

ঈদে মীলাদুন্নবীর সূচনা সম্পর্কে আলোচনা দীর্ঘ হলেও আমরা সুধী পাঠকদের সংক্ষেপেই পুরোপুরি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ! পারস্যের মুসলিম সাম্রাজ্যে প্রাধান্য বিস্তারকারী খ্রিষ্টানরা ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর জন্মদিবস উপলক্ষ্যে ‘ক্রিসমাস ডে’ প্রতিবছরই জাঁকজমকভাবে পালন করত। তাদের সেই আড়ম্বরপূর্ণ জন্মোৎসবের জৌলুসে দুর্বল ঈমানের মুসলিমরা প্রভাবিত হয়ে পড়ে এবং মুসলিম সমাজে খ্রিষ্টানদের ন্যায় নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্মদিবস উদযাপনের রেওয়াজ না থাকায় তারা এটাকে নিজেদের ত্রুটি হিসেবে সাব্যস্ত করে। এরই ধারাবাহিকতায় ইরাকের মুসেল নগরীতে স্বেচ্ছাচারী বাদশাহ মালেক মুযাফফর আবূ সাঈদ কূকবুরী (মৃত ৬৩০ হি.) ৬০৪ হিজরীতে সর্বপ্রথম এই ঈদে মীলাদুন্নবীর সূচনা করেন। এরপর তার দেখাদেখি পারস্যসহ আশেপাশের মুসলিম সমাজের অন্য লোকেরাও মীলাদুন্নবী নামে বিদআতী অনুষ্ঠান পালন শুরু করে।

উক্ত বাদশাহ সম্পর্কে ইমাম আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ মিসরী মালেকী লেখেন, তিনি একজন অপব্যয়ী বাদশাহ ছিলেন। তিনি তার সময়কালের আলেমদের হুকুম দিতেন, তারা যেন তাদের ইজতিহাদ ও গবেষণা অনুযায়ী আমল করে এবং অন্য কারো ইজতিহাদের অনুসরণ না করে। ফলে দুনিয়াপূজারি একদল আলেম তার ভক্ত হয়ে পড়ে।[1]

উক্ত অপব্যয়ী বাদশাহ প্রজাগণের মনোরঞ্জন ও নিজের জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষ্যে প্রতি বছর ১২ই রবীউল আওয়ালকে কেন্দ্র করে মীলাদুন্নবী উদযাপন করতেন এবং এ অনুষ্ঠানে তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে ৩ লক্ষ দীনার ব্যয় করতেন।[2]

অতপর দুনিয়ালোভী দরবারী মৌলভী উমার ইবনু দেহইয়া আবুল খাত্ত্বাব মীলাদ মাহফিল ও জশনে জুলুসের স্বপক্ষে কাল্পনিক প্রমাণ নির্ভর বানোয়াট কিতাব রচনা করে বাদশার কাছ থেকে প্রচুর অর্থ-কড়ি হাতিয়ে নেন। তার ব্যাপারে হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, তিনি আয়িম্মায়ে দ্বীন এবং পূর্বসূরি উলামায়ে কেরামের ব্যাপারে অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য করতেন এবং গালিগালাজে ভরপুর অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করতেন। তিনি কর্কশভাষী, আহাম্মক এবং অহংকারী ছিলেন। আর তিনি ধর্মীয় বিষয়ে ব্যাপারে চরম উদাসীন ছিলেন।[3] তিনি আরো বলেন, ‘আমি মানুষদের তাকে মিথ্যুক ও অবিশ্বাস করার ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ পেয়েছি’।[4]

ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমগণ মধ্যযুগে যেহেতু মুসলিম শাসকদের শাসনে সন্তুষ্ট হয়ে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম হয়েছে, তাই তাদের ব্যবহারিক জীবনে হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব কিছুটা থেকে যায়, যা কালক্রমে আজও বিদ্যমান আছে! এখানকার মুসলিমগণ যখন হিন্দু ছিল, তখন তারা হিন্দুদের বিভিন্ন অবতার বিশেষ করে হিন্দুদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী মহা ধুমধামে পালন করত, তেমনি মুসলিম হওয়ার পরও শ্রীকৃষ্ণের জন্মোৎসবের মতোই ঈদে মীলাদুন্নবী নামে ইসলামের নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্মোৎসব ধুমধাম করে পালন করতে লাগল, যার অবশিষ্টরূপ এখনো ভারতীয় উপমহাদেশে এক শ্রেণির নামধারী মুসলিমদের মধ্যে বলবৎ আছে! আর এরাই শরীআতের দৃষ্টিতে বিদআতী নামে পরিচিত।

মুহাক্কিক্ব উলামায়ে কেরামের দৃষ্টিতে বিদআতী ঈদে মীলাদুন্নবী :

(১) আল্লামা তাজুদ্দীন ফাকেহানী (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন মীলাদ উদ্ভবকালের একজন সুপ্রসিদ্ধ আলেমে দ্বীন। তিনি মীলাদের প্রতিবাদে এক মূল্যবান কিতাব রচনা করেছেন। কিতাবটির নাম ‘আল-মাওরিদ ফিল কালামি আলাল মাওলিদ’।[5]

উক্ত গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘মীলাদের এই প্রথা না কুরআনে আছে, না হাদীছে আছে, আর না পূর্বসূরীদের থেকে তা বর্ণিত আছে। বরং এটি একটি বিদআতী কাজ, যাকে বাতিল ও স্বার্থান্বেষী মহল সৃষ্টি করেছে আর পেটপূজারিরা তা লালন করেছে’।[6]

(২) আল্লামা ইবনুল হাজ্জ মালেকী (রাহিমাহুল্লাহ) ‘মাদখাল’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন ‘লোকেরা যে সমস্ত বিদআতী কর্মকে ইবাদত মনে করে এবং এতে ইসলামের শানশওকত প্রকাশ হয় বলে ধারণা করে, তন্মধ্যে রয়েছে মীলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান। রবীউল আওয়াল মাসে বিশেষ করে এ আয়োজন করা হয়। বস্তুত এসব আয়োজন অনুষ্ঠানে অনেক বিদআত ও হারাম কাজ সংঘটিত হয়’।[7]

(৩) আল্লামা ইবনু তায়মিয়্যা (রাহিমাহুল্লাহ) লিখেছেন, প্রচলিত এই মীলাদ অনুষ্ঠান সালাফে ছালেহীনের যুগে ছিল না। যদি এ কাজে কোনো ফযীলত ও বরকত থাকত, তবে পূর্বসূরীরা আমাদের চাইতে বেশি হক্বদার ছিলেন। কারণ তারা নবীপ্রেমের ক্ষেত্রে আমাদের চাইতে অনেক অগ্রগামী এবং ভালো কাজে অধিক আগ্রহী ছিলেন।[8]

(৪) আল্লামা ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, মীলাদ অনুষ্ঠান কি বিদআত, না শরীআতে এর কোনো ভিত্তি আছে? জবাবে তিনি বলেন, ‘মীলাদ অনুষ্ঠান মূলত বিদআত। তিন পবিত্র যুগের সালাফে ছালেহীনের আমলে এর অস্তিত্ব ছিল না’।[9]

(৫) রশীদ আহমাদ গাংগুহী (রাহিমাহুল্লাহ) এক প্রশ্নের জবাবে লিখেন, ‘মীলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান সর্বাবস্থায় নাজায়েয। মানদূব কাজের জন্য ডাকাডাকি করা শরীআতে নিষিদ্ধ’। আল্লাহ সর্বজ্ঞ। তিনি অন্যত্র লিখেন, ‘বর্তমান যুগের মাহফিলগুলো যথা— মীলাদ, ওরশ, চল্লিশা সবই বর্জন করা দরকার। কেননা এগুলোর অধিকাংশ গুনাহ ও বিদআত থেকে মুক্ত নয়’।[10]

(৬) আশরাফ আলী থানবী (রাহিমাহুল্লাহ) প্রচলিত ঈদে মীলাদুন্নবীর যৌক্তিকতা খণ্ডনের পর লিখেন, ‘মোটকথা, যুক্তি ও শরীআত উভয় দিক দিয়ে প্রমাণিত হলো যে, এই নবোদ্ভাবিত ঈদে মীলাদুন্নবী নাজায়েয, বিদআত এবং পরিত্যাজ্য’।[11]

(৭) সঊদী আরবের সাবেক প্রধান মুফতী আল্লামা শায়খ আব্দুল আযীয ইবনে বায (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ফতওয়ায় তিনি এক প্রশ্নের জবাবে লিখেন, ‘কুরআন-সুন্নাহ তথা অন্যান্য শারঈ দলীল মতে ঈদে মীলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান ভিত্তিহীন এবং স্পষ্ট বিদআত। এতে ইয়াহূদী, খ্রিষ্টান এবং সনাতন হিন্দু আদর্শের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। এসব অনুষ্ঠানে মুসলিমদের যোগদান করা নাজায়েয। কেননা এর দ্বারা বিদআতের সম্প্রসারণ ও এর প্রতি উৎসাহ যোগানো হয়’।[12]

(৮) উপমহাদেশের সকল মুহাক্কিক্ব উলামায়ে কেরাম, বিশেষ করে মুজাদ্দিদে আলফে ছানী, শায়খ আহমাদ সারহিন্দী, আল্লামা হায়াত সিন্ধী, রশীদ আহমাদ গাংগুহী, আশরাফ আলী থানভী, মাহমূদুল হাসান দেউবন্দী, আহমাদ আলী সাহারানপুরী প্রমুখ উলামায়ে কেরাম ছাড়াও আহলেহাদীছের সকল বিদ্বান এক বাক্যে প্রচলিত মীলাদ অনুষ্ঠান (ঈদে মীলাদুন্নবী)-কে বিদআত ও গুনাহের কাজ বলেছেন।[13]

সুতরাং উল্লেখিত আলোচনার ভিত্তিতে শারঈ দৃষ্টিতে দ্বীনের নামে ঈদে মীলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান উদযাপন করা মারাত্মক বিদআত ও নাজায়েয, যা বর্জন করা প্রকৃত মুসলিমের জন্য জরুরী।

বিদআতী ঈদে মীলাদুন্নবী ও জশনে জুলুস :

রবীউল আওয়াল মাসের ১২ তারিখ এলেই ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম নামধারী এক শ্রেণির বিদআতী নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্মদিন পালনের নামে জশনে জুলুসে ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন করে, যা সনাতন হিন্দুধর্মের অবতারের জন্মোৎসব আর খ্রিষ্টানদের বড়দিন উদযাপনের সাথে পুরোপুরি সাদৃশ্যপূর্ণ। একে কেন্দ্র করে দেয়াল লিখন, ব্যানার বানানো, সভা-সমাবেশ, গেইট সাজানো, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শানে ক্বাছীদা পাঠ, নকল বায়তুল্লাহ ও রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কবরের প্রতিকৃতি নিয়ে নারী-পুরুষের সম্মিলিত শোভাযাত্রা, ঢোল-তবলা ও হারমোনিয়াম সজ্জিত ব্যান্ডপার্টির গগণবিদারী নিবেদন (!), গান-বাজনা এবং নারী-পুরুষের উদ্দাম নাচানাচি ও অবাধ ঢলাঢলি। অবশেষে মিষ্টি ও তবারক বিতরণ করা হয়ে থাকে এবং এটাকে মহাপুণ্যের কাজ ও শ্রেষ্ঠ ঈদ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। নাঊযুবিল্লাহ!

শরীআতের দৃষ্টিতে ঈদে মীলাদুন্নবী এবং জশনে জুলুসের হুকুম :

(১) ইসলামে কোনো মানুষের এমনকি কোনো মহা মনীষীরও জন্ম কিংবা মৃত্যুদিবস পালনের কোনো শারঈ বিধান নেই। যদি থাকত, তাহলে বছরের প্রত্যেক তথা ৩৬৫ দিনই জন্ম বা মৃত্যুদিবস পালন করতে হতো। কেননা লক্ষ-লক্ষ নবী-রাসূল ও লক্ষ-লক্ষ ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন এবং শত সহস্র মনীষী দুনিয়াতে আগমন করে বিদায় নিয়ে গেছেন। আর অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, বছরের প্রত্যেক দিনই কোনো না কোনো নবী কিংবা ছাহাবী কিংবা কোনো মনীষী জন্মগ্রহণ বা মৃত্যুবরণ করেছেন। ফলে সারা জীবন কেবল জন্ম কিংবা মৃত্যুদিবস পালনেই কেটে যাবে। আল্লাহর হুকুম, ফরয ইবাদত পালনের সুযোগ হবে না। কখনো দেখা যাবে, একই দিনে কোনো মনীষীর জন্ম, আবার কারো মৃত্যু হয়েছে। তখন একই দিন জন্ম ও মৃত্যুদিবস পালন করতে হবে- যার পরিণতি হবে সমাজে সর্বদা বিশৃঙ্খলা, গোলযোগ ও মারামারি। অথচ ইসলাম মানুষকে সুশৃঙ্খল যিন্দেগী যাপন করা শেখায়।

(২) নবীজী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুঅত লাভের পর ২৩ বছর জীবিত ছিলেন। অতঃপর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইন্তিকালের পর ছাহাবায়ে কেরাম ১০০/১১০ বছর পর্যন্ত দুনিয়াতে ছিলেন। এই সুদীর্ঘ কালের প্রতি বছরই রবীউল আওয়াল মাস আসত, কিন্তু কোনো বছরই না রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বয়ং নিজের জন্মদিন পালন করেছেন, না কোনো ছাহাবী (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) কোনোদিন করেছেন।

(৩) জাহেলী যুগে মদীনাবাসীরা বছরে দুটি উৎসব পালন করত। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরতের পর মদীনায় আগমন করে বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য এ দুটি দিনের চেয়ে উত্তম দুটি দিন তথা ঈদুল ফিত্বর ও ঈদুল আযহা নির্ধারণ করে দিয়েছেন’।[14]

এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মুসলিম কখনো নিজেরা নিজেদের ঈদ নির্ধারণ করতে পারে না; বরং তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয়ে থাকে। আল-কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী মুসলিমদের ঈদ হলো দুটি— ঈদুল ফিত্বর ও ঈদুল আযহা। সুতরাং ঈদুল ফিত্বর ও ঈদুল আযহা ব্যতীত তৃতীয় কোনো দিনকে অন্য কোনো ঈদ হিসেবে নির্ধারণ করলে সেটা হবে স্পষ্ট বিদআত ও গোমরাহি এবং কুরআন-সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক। ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন এবং তাবে তাবেঈন এই তিন সোনালী যুগে যার কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। কুরআন-সুন্নাহ ও আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীনের আলোচনায় দুই ঈদের অধ্যায় আছে এবং মাসায়েলের আলোচনা আছে, কিন্তু ঈদে মীলাদুন্নবীর নামে না আছে কোনো অধ্যায়, না আছে কোন ফাযায়েল ও মাসায়েলের আলোচনা! এ ঈদ যেমন মনগড়া, তা পালনের রীতিও মনগড়া। এ ক্ষেত্রে যে সকল ফযীলতের কথা বর্ণনা করা হয়, সেসবও জাল এবং বানোয়াট। নির্ভরযোগ্য কোনো হাদীছের কিতাবে সেগুলোর নাম-গন্ধও নেই। প্রমাণের জন্য বাংলায় অনূদিত হাদীছ ও ফিক্বহের কিতাবগুলো দেখা যেতে পারে। সেগুলোতে দুই ঈদের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু কথিত ঈদে মীলাদুন্নবীর নামে বানোয়াট বিদআতী শ্রেষ্ঠ ঈদের আলোচনা কুরআন-হাদীছের কোথাও নেই।

ঈদে মীলাদুন্নবী বিদআত কেন?

শরীআতে ঈদে মীলাদুন্নবীর কোনো দলীল নেই। খোদ নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বা তাঁর কোনো ছাহাবী, কোনো তাবেঈ বা কোনো ইমামই তা পালন করেননি, আর খোলাফায়ে রাশেদীনও এটা করার নির্দেশও দেননি। সর্বপ্রথম ঈদে মীলাদ (নবীদিবস) আবিষ্কার করেন ইরাকের ইরবিল শহরের আমীর (গভর্নর) মুযাফফর উদ্দীন কূকুবুরী ঠিক হিজরী সপ্তম শতাব্দীর গোড়ার দিকে ৬০৪ (মতান্তরে ৬২৫) হিজরীতে। মিসরে সর্বপ্রথম চালু করে ফাতেমীরা; যাদের প্রসঙ্গে ইবনু কাছীর বলেন, ‘(ফাতেমী শাসকগোষ্ঠী) কাফের, ফাসেক্ব, পাপাচার, ধর্মব্যবসায়ী, ধর্মদ্রোহী, আল্লাহর ছিফাত (গুণাবলি) অস্বীকারকারী ও ইসলাম অস্বীকারকারী মাজূসী (অগ্নিপূজক) ছিল’।[15]

আসুন! বিদআত বর্জন করিকুরআন ছহীহ সুন্নাহ আঁকড়ে ধরি :

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি (ধর্মীয় বিষয়ে) অভিনব কিছু (বিদআত) রচনা করবে বা বিদআতীকে আশ্রয় দেবে, তার উপর আল্লাহ, ফেরেশতাগণ এবং সকল মানুষের অভিশাপ। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার কোনো ফরয ও নফল ইবাদত কবুল করবেন না।[16]

মুহাম্মাদুর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার জীবদ্দশায় কখনো ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করলেন না, দুনিয়ায় জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীন তা পালন করলেন না, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হেদায়াতপ্রাপ্ত ছাহাবীগণ (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) কেউই পালন করলেন না, তাবেঈগণ পালন করলেন না, তাবে-তাবেঈন পালন করলেন না, প্রচলিত চার মাযহাবের সম্মানিত ইমামসহ কেনো ইমামই ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করলেন না, অথচ সেই ঈদে মীলাদুন্নবীর মতো বিদআতী আমল আজ আপনি রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি মেকি ভালোবাসার নামে মহা ধুমধামে কীভাবে পালন করছেন?! তার মানে, আপনি কি হিদায়াতপ্রাপ্ত ছাহাবীগণের চেয়েও রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বেশি ভালোবাসেন? কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কোথায় ঈদে মীলাদুন্নবীর কথা আছে? ইসলামে ঈদ তো দুটি। আপনি কোথায় পেলেন তৃতীয় ঈদ ‘ঈদে মীলাদুন্নবী?’

ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, مَنْ أَحْدَثَ فِيْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ فَهُوَ رَدٌّ ‘যে এমন কিছুর অনুপ্রবেশ ঘটালো, যা আমাদের শরীআতে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[17] রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেন, ‘তোমাদের উপর পালনীয় হলো আমার সুন্নাত ও আমার হেদায়তপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত। তোমরা তা শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরো। আর ধর্মের নামে নতুন সৃষ্টি হতে সাবধান। নিশ্চয়ই প্রত্যেক নতুন সৃষ্টি বিদআত ও প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা’।[18]

আল্লাহর নিকট ইসলামই হচ্ছে একমাত্র মনোনীত দ্বীন। আল-কুরআনে আল্লাহ বলেন,

وَمَنْ يَّبْتَغِ غَيْرَ الْاِ سْلَا مِ دِيْنًا فَلَنْ يُّقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِى الْاٰ خِرَةِ مِنَ الْخٰسِرِيْنَ

‘আর যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীনের অন্বেষণ করবে, তা কখনোই তার নিকট থেকে কবুল করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান/৮৫)। এ দ্বীন ইসলামকে পরিপূর্ণ করার ঘোষণা আল্লাহ কুরআনে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম’ (আল-মায়েদা/৩)। এ ঘোষণার পর কুরআন ও সুন্নাহর বাইরে দ্বীনের মধ্যে নতুন কোনো বিষয় সংযোজিত হওয়ার পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেছে এবং বিদআত তথা নতুন যে কোনো বিষয় দ্বীনী আমল ও আক্বীদা হিসেবে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত হওয়াও হারাম হয়ে গেছে।

মনে রাখবেন, বিদআত হলো আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে নতুন করে যার প্রচলন করা হয়েছে এবং এর পক্ষে শরীআতের কোনো ব্যাপক বা সাধারণ কিংবা খাছ ও সুনির্দিষ্ট দলীল নেই। তাই মীলাদুন্নবী শরীআতে নবউদ্ভাবিত একটি বিদআত, যার শরীআতে কোনো খাছ বা সুনির্দিষ্ট কোনো দলীল নেই। তাই এসব বিদআতী আমলে পুরস্কার তো দূরের কথা, বরং সেদিন গ্রেফতার হবার জন্য আপনি প্রস্তুত থাকুন।

প্রথমত, আপনি বিদআতী কাজকর্ম অর্থাৎ বিদআতী আমল করার কারণে কিয়ামতের দিন হাওযে কাওছারের পানি পান করতে পারবেন না। অথচ এ পানি পান করলে কিয়ামত পর্যন্ত কেউ কোনো দিন পিপাসিত হবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাকে কাওছার দান করেছি’ (আল-কাওছার, ১০৮/১)

আব্দুল্লাহ ইবনু যায়েদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা হাওযে কাওছারে আমার সঙ্গে মিলিত হওয়া পর্যন্ত ছবর করতে থাকবে’। আহমাদ ইবনু ছালেহ (রাহিমাহুল্লাহ) সাঈদ ইবনুল মূসাইয়্যাব (রাহিমাহুল্লাহ) নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ছাহাবী থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের থেকে কতিপয় লোক আমার সামনে হাওযে কাওছারে উপস্থিত হবে। তারপর তাদেরকে সেখান থেকে পৃথক করে নেওয়া হবে। তখন আমি বলব, হে রব! এরা আমার উম্মত। তিনি বলবেন, আপনার পরে এরা (ধর্মে নতুন সংযোজনের মাধ্যমে) কী কীর্তিকলাপ করেছে সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনার জানা নেই। নিঃসন্দেহে এরা দ্বীন থেকে পিছনের দিকে ফিরে গিয়েছিল’।[19]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রসূলের (রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর) আনুগত্য করো এবং নিজেদের কর্মফল বিনষ্ট করো না’ (মুহাম্মাদ৪৭/৩৩)

হে আল্লাহ! আমাদেরকে দ্বীন ইসলামের নামে সকল বিদআতী কাজ বিশেষ করে ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের মতো স্পষ্ট বিদআত পালন করা থেকে বিরত থাকার তাওফীক দান করুন- আমীন!

* পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

[1]. আল-ক্বাওলুল মু‘তামাদ ফী আমলিল মাওলিদ, রাহে সুন্নাত সূত্রে, পৃ. ১৬২।

[2]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১৩/১৩৯-১৪০।

[3]. লিসানুল মীযান, ৪/২৯৬।

[4]. প্রাগুক্ত, ৪/২৯০।

[5]. কিতাবটির বঙ্গানুবাদ অনেক অভিজাত পুস্তকালয়ে পাওয়া যায়, আপনারা কিনে পড়তে পারেন। -লেখক

[6]. বারাহিনে ক্বাতিআ, পৃ. ১৬৪।

[7]. মাদখাল, ১/৯৮৫; আল-মিনহাজুল ওয়াজিহ, পৃ. ২৫২।

[8]. ইকতিজা উসসিরাতিল মুস্তাক্বীম, পৃ. ২৬৫।

[9]. হিওয়ার মাআল মালিকী, পৃ. ১৭৭।

[10]. ফতওয়া রাশেদিয়া, পৃ. ১৩১।

[11]. আশরাফুল জওয়াব, পৃ. ১৩৮।

[12]. মাজমূউল ফাতাওয়া, ৪/২৮০।

[13]. মীলাদুন্নবী, পৃ. ৩২-৩৩।

[14]. সুনানে নাসাঈ, হা/১৫৫৬ ‘হাদীছ ছহীহ’।

[15]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১৩/৩৪৬।

[16]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৭৫৫; ছহীহ মুসলিম, হা/৩৩৯৩, ৩৮৬৭।

[17]. ছহীহ বুখারী (তাওহীদ প্রকাশনী), হা/২৬৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/৪৩৮৪; আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৬।

[18]. আহমাদ, হা/১৬৬৯৪; আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭; তিরমিযী, হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ, হা/৪২; মিশকাত, হা/১৬৫ ‘হাদীছ ছহীহ’।

[19]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৫৮৫।

Comments