রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত বনাম প্রচলিত ছালাত **-আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ (পর্ব-২৫)

 **-আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ

(পর্ব-২৫)

সালাম ফিরানোর পর সাথে সাথে উঠা যাবে না :

সালাম ফিরানোর পরপরই তাড়াহুড়া করে উঠে যাওয়া খারাপ অভ্যাস। এ খারাপ অভ্যাসকে ছাহাবীগণ কঠোরভাবে দমন করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে রাবাহ (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণের একজন হতে বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাঃ) আছরের ছালাত আদায় করেন। সালাম ফিরানোর সাথে সাথে একজন লোক দাঁড়িয়ে যান। ওমর (রাঃ) তাকে দেখতে পান এবং ঘাড় ধরে বলেন, বসে যান। নিশ্চয় পূর্বের লোকেরা ধ্বংস হয়েছে একারণে যে, তারা দুই ছালাতের মাঝে বিরতি দিত না। রাসূল (ছাঃ) তখন ওমর (রাঃ)-কে বললেন, ‘তুমি ঠিক করেছো’।[1] এ হাদীছ প্রমাণ করে, দুই ছালাতের মাঝে বিরতি হতে হবে এবং তাসবীহ, তাহলীল ও যিকিরের মাধ্যমে কিছু সময় অতিবাহিত করতে হবে, তারপর অন্য ছালাত আদায় করতে হবে।

সালাম ফিরানোর পর মাথায় হাত রেখে দু‘আ পড়া যাবে না :

সালাম ফিরানোর পর মাথায় হাত রেখে দু‘আ পড়ার প্রমাণে কোন ছহীহ হাদীছ নেই। এ আমল পরিহার করতে হবে। আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) যখন ছালাত আদায় করতেন, তখন ডান হাত তার মাথায় রাখতেন এবং বলতেন, ‘আল্লাহর নামে শুরু করছি যিনি ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই, যিনি পরম করুণাময়, দয়ালু। হে আল্লাহ! আমার থেকে চিন্তা ও পেরেশানী দূর করে দাও’।[2] হাদীছটি যঈফ।[3] আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) যখন তার ছালাত শেষ করতেন তখন ডান হাত দ্বারা তার মাথা মাসাহ করতেন এবং এই দু‘আ পড়তেন,

أشهد أن لاإله إلا الله الرحمن الرحيم اللهم أذهب عني الهم والحزن

‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই। তিনি রহমান, তিনি রহীম, হে আল্লাহ! আমার চিন্তা ও আশঙ্কা দূর কর’।[4] হাদীছটি অত্যন্ত যঈফ।[5] উক্ত হাদীছ দু’টি আমলযোগ্য নয়। অতএব এ আমল যরূরীভাবে পরিহার করতে হবে।

আয়াতুল কুরসী পড়ে বুকে ফুঁক দেয়া যাবে না :

সমাজে প্রচলিত আছে, অনেকেই ফরয ছালাতের পর আয়াতুল কুরসী পড়ে বুকে ফুঁক দেয়। এ আমল বিদ‘আত, যা পরিহার করা যরূরী। তবে ফরয ছালাতের পর আয়াতুল কুরসী পড়ার বড় ফযীলত রয়েছে। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِي أُمَامَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ قَرَأَ آيَةَ الْكُرْسِيِّ فِي دُبُرِ كُلِّ صَلَاةٍ مَكْتُوبَةٍ لَمْ يَمْنَعْهُ مِنْ دُخُولِ الْجَنَّةِ إِلَّا أَنْ يَمُوتَ».

আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয ছালাতের পর আয়াতুল কুরসী পাঠ করে, তার মাঝে এবং জান্নাতের মাঝে দূরত্ব থাকে শুধু মৃত্যু’।[6]

‘ফাকাশাফনা আনকা গিত্বাআকা’ পড়ে চোখ মাসাহ করা যাবে না :

সূরা ক্বাফ-এর ২২ নং আয়াত পড়ে বৃদ্ধা আঙ্গুলে ফুঁক দিয়ে চোখে মাসাহ করা বিদ‘আত। এ আমল রাসূল (ছাঃ) করেননি, ছাহাবীগণ (রাঃ) করেননি। তবে যে কোন রোগের জন্য রাসূল (ছাঃ) সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস পড়ে ফুঁক দিতেন। কেউ কোন রোগ-ব্যাধির কথা বললে তিনি এ সূরা দু’টি পড়ে ফুঁক দিতেন।[7]

ফজরের ছালাতের পর সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত পড়া যাবে না :

এ আমল করা যাবে না। কারণ এর প্রমাণে যে হাদীছ পেশ করা হয়েছে, তা যঈফ। হাদীছটি হল,

عَنْ مَعْقِلِ بْنِ يَسَارٍ عَنِ النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ « مَنْ قَالَ حِينَ يُصْبِحُ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ أَعُوذُ بِاللَّهِ السَّمِيعِ الْعَلِيمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ وَقَرَأَ ثَلاَثَ آيَاتٍ مِنْ آخِرِ سُورَةِ الْحَشْرِ وَكَّلَ اللَّهُ بِهِ سَبْعِينَ أَلْفَ مَلَكٍ يُصَلُّونَ عَلَيْهِ حَتَّى يُمْسِىَ وَإِنْ مَاتَ فِى ذَلِكَ الْيَوْمِ مَاتَ شَهِيدًا وَمَنْ قَالَهَا حِينَ يُمْسِى كَانَ بِتِلْكَ الْمَنْزِلَةِ ». قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ لاَ نَعْرِفُهُ إِلاَّ مِنْ هَذَا الْوَجْهِ.

মা‘কিল ইবনে ইয়াসার (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সকালে তিনবার أَعُوذُ بِاللَّهِ السَّمِيعِ الْعَلِيمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ সহ সূরা হাশরের শেষ তিনটি আয়াত পড়বে, আল্লাহ তার জন্য ৭০ হাযার ফেরেশতা নিযুক্ত করবেন, যারা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। যদি ঐদিন ঐব্যক্তি মারা যায়, তাহলে শহীদ হয়ে মারা যাবে আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় পড়বে, তার জন্যও একই ফযীলত রয়েছে’।[8] হাদীছটি যঈফ।[9] অতএব ফজরের ছালাতের পর এ আমল করা যাবে না। তবে সূরা মুলক পড়তে পারে।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ سُورَةً فِي الْقُرْآنِ ثَلَاثُونَ آيَةً شَفَعَتْ لِرَجُلٍ حَتَّى غُفِرَ لَهُ وَهِيَ: (تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ)

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘পবিত্র কুরআনের এমন একটি সূরা আছে, যার ৩০টি আয়াত রয়েছে। যে ব্যক্তি ঐ সূরা পাঠ করবে, তার জন্য এই সূরা সুপারিশ করবে, যতক্ষণ তাকে ক্ষমা না করা হবে; আর সেটি হচ্ছে সূরা মূলক’।[10]

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রত্যেক রাতে সূরা মুলক পড়বে, আল্লাহ তাকে কবরের আযাব হতে মুক্তি দিবেন আর আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে এই সূরাকে আল-মানে‘আহ বলতাম।[11] এই হাদীছ প্রমাণ করে, কবরের শাস্তি হতে মুক্তির আশায় প্রত্যেক রাতে সূরা মুলক পড়া উচিত। আল্লাহ তুমি আমাদের সকলকে এই গুরুত্বপূর্ণ আমল করার তাওফীক্ব দান কর।

ফরয ছালাত পরে প্রচলিত মুনাজাত করা যাবে কি?

অধিকাংশ মসজিদে ফরয ছালাতের সালাম ফিরানোর পর দুই হাত তুলে প্রচলিত মুনাজাত করা হয়, যা এই উজ্জ্বল শরী‘আতে সুস্পষ্ট বিদ‘আত। যদিও এক শ্রেণীর আলেম এ বিদ‘আত বহাল রাখার জন্য জীবনবাজি রেখে চেষ্টা করে যাচ্ছেন এবং এর প্রমাণে কিছু জাল-যঈফ হাদীছ পেশ করছেন।

প্রচলিত মুনাজাতের প্রমাণে পেশকৃত কিছু যঈফ হাদীছ :

عَنْ اَنَسِ بْنِ مَالِكٍ عَنِ النَّبِىِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَنَّهُ قَالَ مَا مِنْ عَبْدٍ بَسَطَ كَفَّيْهِ فِىْ دُبُرِ كُلِّ صَلاَةٍ ثُمَّ يَقُوْلُ اَللّهُمَّ اِلهىْ وَإِلَهَ اِبْرَاهِيْمَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوْبَ وَإلَهَ جِبْرِيْلَ وَمِيْكَائِيْلَ وَاِسْرَافِيْلَ عَلَيْهِمُ السَّلاَمُ اَسْأَلُكَ اَنْ تَسْتَجِيْبَ دَعْوَتِىْ فَاِنِّىْ مُضْطَرُّ وَتَعْصِمُنِىْ فِىْ دِيْنِىْ فَاِنِّىْ مُبْتَلَى وَتَنَالُنِىْ بِرَحْمَتِكَ فَاِنِّىْ مُذْنِبٌ وَتُنْفِىْ عَنِّى الْفَقْرَ فَاِنِّىْ مُتَمَسِّكُنَّ إِلاَّ كَانَ حَقًّا عَلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ اَنْ لاَ يَرُدَّ بِهِ خَائِبَتَيْنِ –

(১) আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, যখন কোন বান্দা প্রত্যেক ছালাতের পর দু’হাত প্রশস্ত করে, অতঃপর বলে, হে আমার মা‘বূদ এবং ইবরাহীম, ইসহাক, ইয়া‘কূব (আঃ)-এর মা‘বূদ এবং জিবরীল, মীকাঈল ও ইসরাফীল (আঃ)-এর মা‘বূদ! তোমার কাছে আমি চাচ্ছি, তুমি আমার প্রার্থনা কবুল কর। আমি বিপথগামী, তুমি আমাকে আমার দ্বীনের উপর রক্ষা কর। তুমি আমার উপর রহমত বর্ষণ কর। আমি অপরাধী, তুমি আমার দরিদ্রতা দূর কর। আমি শক্তভাবে তোমাকে গ্রহণ করি। তখন আল্লাহর উপর হক্ব হয়ে যায় তার খালি হাত দু’খানা ফেরত না দেওয়া’।[12]

عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَفَعَ يَدَيْهِ بَعْدَ مَا سَلَّمَ وَهُوَ مُسْتَقْبِلُ الْقِبْلَةِ فَقَالَ اَللّهُمَّ خَلِّصِ الْوَلِيْدَ بْنَ الْوَلِيْد وَعَيَّاشَ بْنَ اَبِىْ رَبِيْعَةَ وَ سَلَمَةَ بْنَ هِشَامٍ وَضُعْفَةَ الْمُسْلِمِيْنَ الَّذِيْنَ لاَ يَسْتَطِيْعُوْنَ حِيْلَةً وَلاَ يَهْتَدُوْنَ سَبِيْلاً-

(২) আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, একদা রাসূল (ছাঃ) সালাম ফিরানোর পর ক্বিবলামুখী হয়ে দু’হাত উঠালেন এবং বললেন, হে আল্লাহ! ওয়ালীদ ইবনু ওয়ালীদকে পরিত্রাণ দাও। আইয়াশ, ইবনু আবী রবী‘আহ, সালাম ইবনু হিশাম এবং দুর্বল মুসলিমদের পরিত্রাণ দাও। যারা কোন কৌশল জানে না। যারা কাফেরদের হাত হতে বাঁচার কোন পথ পায় না’।[13] আলোচ্য হাদীছে আলী ইবনু যায়েদ ইবনে জাদ‘আন যঈফ রাবী।[14] আলোচ্য হাদীছটি ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত হাদীছের বিরোধী। আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত বুখারীর হাদীছে ছালাতের মধ্যে রূকূর পর দু‘আ করার কথা রয়েছে। অথচ এই দুর্বল হাদীছে সালামের পরের কথা রয়েছে। বুখারীর হাদীছে হাত তোলার কথা নেই। কিন্তু এ হাদীছে হাত তোলার কথা বলা হয়েছে। অথচ ঘটনা একটিই এবং দু‘আ হল দু‘আয়ে কুনূত।

অতএব ছালাতের পর দলবদ্ধভাবে দু‘আর প্রমাণে পেশ করা শরী‘আত বিকৃত করার শামিল।

عَنِ الْفَضْلِ بْنِ الْعَبَّاسِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصَّلاةُ مَثْنَى مَثْنَى، تَشَهَّدْ فِيْ كُلِّ رَكْعَتَيْنِ، وَتَضَرَّعْ، وَتَخَشَّعْ، وَتَمَسْكَنْ، ثُمَّ تُقْنِعْ يَدَيْكَ، يَقُوْلُ تَرْفَعْهُمَا إِلَى رَبِّكَ مُسْتَقْبِلاً بِبُطُوْنِهِمَا وَجْهَكَ، وَتَقُوْلُ يَا رَبِّ يَا رَبِّ، فَمَنْ لَّمْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَهُوَ كَذَا وَفِيْ رِوَايَةٍ فَهُوَ خِدَاجٌ-

(৩) ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ছালাত দু’দু’রাক‘আত এবং প্রত্যেক দু’রাক‘আতেই তাশাহহুদ, ভয়, বিনয় ও দীনতার ভাব থাকবে। অতঃপর তুমি ক্বিবলামুখী হয়ে তোমার দু’হাতকে তোমার মুখের সামনে উঠাবে এবং বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক! যে এরূপ করবে না, তার ছালাত অসম্পূর্ণ’।[15] হাদীছটি যঈফ। আব্দুল্লাহ ইবনু নাফে‘ ইবনিল আময়া যঈফ রাবী।[16] তাছাড়া হাদীছটিতে নফল ছালাতের কথা বলা হয়েছে এবং তা এককভাবে।

عَنْ خَلاَّدِ بْنِ السَّائِبِ اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ اِذَا دَعَا رَفَعَ رَاحَتَيْهِ اِلَى وَجْهِهِ-

(৪) খাল্লাদ ইবনু সায়েব (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) যখন দু‘আ করতেন, তখন তার দু’হাত মুখের সামনে উঠাতেন’।[17] হাদীছটি যঈফ। হাফছ ইবনু হাশেম ইবনে উতবা যঈফ রাবী।[18]

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبَّاسٍ اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لاَ تَسْتُرُوْا الجُدُرَ مَنْ نَظَرَ فِىْ كِتَابِ اَخِيْهِ بِغَيْرِ اِذْنِهِ فَاِنَّمَا يَنْظُرُ فِىْ النَّارِ سَلُوْا اللهَ بِبُطُوْنِ اَكُفِّكُمْ وَلاَ تَسْأَلُوْهُ بِظُهُوْرِهَا فَاِذَا فَرَغْتُمْ فَامْسَحُوْا بِهَا وُجُوْهَكُمْ-

(৫) আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা হাতের পেট দ্বারা চাও, পিঠ দ্বারা চেয়ো না। অতঃপর তোমরা যখন দু‘আ শেষ কর, তখন তোমাদের হাত দ্বারা চেহারা মুছে নাও’।[19] হাদীছটি যঈফ।[20] নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহিঃ) বলেন, হাদীছটিতে ছালেহ ইবনু হাসান নামক রাবী যঈফ এবং হাদীছের শেষে চেহারা মুছে নেওয়ার অংশটুকু অপরিচিত। এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।[21]

প্রকাশ থাকে যে, হাত তুলে দু‘আ করার পর হাত মুখে মোছার প্রমাণে কোন ছহীহ হাদীছ নেই।[22]

عَنِ السَّائِبِ بْنِ يَزِيْدَ عَنْ اَبِيْهِ اَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ دَعَا فَرَفَعَ يَدَيْهِ وَمَسَحَ وَجْهَهُ بِيَدَيْهِ –

(৬) সায়েব ইবনু ইয়াযীদ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাঃ) যখন দু‘আ করতেন, তখন দু’হাত উঠাতেন এবং দু’হাত দ্বারা চেহারা মুছে নিতেন’।[23] হাদীছটি যঈফ। আলোচ্য হাদীছে আব্দুল্লাহ ইবনু লাহইয়াহ নামক একজন যঈফ রাবী রয়েছে।[24]

اَلْاَسْوَدُ الْعَامِرِى عَنْ اَبِيْهِ قَالَ صَلَّيْتُ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَلْفَجْرَ فَلَمَّا سَلَّمَ اِنْحَرَفَ وَرَفَعَ يَدَيْهِ وَدَعَا-

(৭) আসওয়াদ আমেরী তার পিতা হতে বর্ণনা করেন, তার পিতা বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ফজরের ছালাত আদায় করেছি। যখন তিনি সালাম ফিরালেন এবং ঘুরলেন, তখন হাত উঠিয়ে দু‘আ করলেন’।[25]

প্রকাশ থাকে যে, رَفَعَ يَدَيْهِ وَدَعَا ‘রাসূল (ছাঃ) তাঁর দু’হাত উঠালেন এবং দু‘আ করলেন’ এ অংশটুকু মূল হাদীছে নেই। মিয়াঁ নাযীর হুসাইন (রহঃ) এবং আল্লামা মুবারকপুরী (রহঃ) হয়তোবা তদন্ত না করে তাদের কিতাবে লিখেছেন। তাই এখনও যারা বক্তব্য বা লেখনীর মাধ্যমে এ হাদীছ প্রচার করতে চান, তাদেরকে অবশ্যই হাদীছের মূল কিতাব দেখে পরিত্যাগ করতে হবে। অন্যথা তারা হবেন নবী (ছাঃ)-এর উপর মিথ্যারোপকারী এবং মিথ্যা প্রচারকারী, যাদের পরিণতি ভয়াবহ।[26]

عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ اَبِىْ يَحْيَى الْاَسْلاَمِىْ قَالَ رَأَيْتُ عَبْدَ اللهِ بْنَ الزُّبَيْرِ رَأى رَجُلاً رَافِعًا يَدَيْهِ يَدْعُوْ قَبْلَ اَنْ يَفْرُغَ مِنْ صَلاَتِهِ فَلَمَّا فَرَغَ مِنْهَا قَالَ اِنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمْ يَكُنْ يَرْفَعُ يَدَيْهِ حَتَّى يَفْرُغَ مِنْ صَلاَتِهِ-

(৮) আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ) একজন লোককে ছালাত শেষ হওয়ার পূর্বে হাত তুলে দু‘আ করতে দেখলেন। যখন তিনি দু‘আ শেষ করলেন, তখন আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের তাকে বললেন, রাসূল (ছাঃ) ছালাত শেষ না করলে হাত তুলে দু‘আ করতেন না।[27] হাদীছটি যঈফ, মুনকার ও ছহীহ হাদীছের বিরোধী। ছহীহ হাদীছে ছালাতের মধ্যে রুকূর পর কুনূতে নাযেলা পড়ার সময় হাত তোলার কথা আছে।[28] তবে ছালাতের পর হাত তোলার কোন ছহীহ হাদীছ নেই।

عَنْ اَبِىْ نُعَيْمٍ قَالَ رَأَيْتُ ابْنَ عُمَرَ وَابْنَ الزُّبَيْرِ يَدْعُوَانِ يُدِيْرَانِ بِالرَّاحَتَيْنِ عَلَى الْوَجْهِ-

(৯) আবু নুআঈম (রাঃ) বলেন, আমি ইবনু ওমর ও ইবনু যুবায়ের (রাঃ)-কে তাদের দু’হাতের তালু মুখের সামনে করে দু‘আ করতে দেখেছি’।[29] এই হাদীছে মুহাম্মাদ ইবনু ফোলাইহ এবং তার পিতা দু’জন যঈফ রাবী রয়েছে।[30]

(১০) আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘যখন আদম সন্তানের কোন দল একত্রিত হয়ে কেউ কেউ দু‘আ করে, আর অন্যরা আমীন বলে, আল্লাহ তাদের দু‘আ কবুল করেন’।[31] হাদীছটি যঈফ। এতে ইবনু লাহইয়াহ নামে দুর্বল রাবী রয়েছে।[32]

(১১) একদা আলী হাযরামী (রাঃ) লোকদের নিয়ে ছালাত আদায় করেন। ছালাত শেষে হাঁটু গেড়ে বসেন, লোকেরাও হাঁটু গেড়ে বসে। তিনি হাত তুলে দু‘আ করেন এবং লোকেরা তার সাথে ছিল।[33] এ ঘটনা ইতিহাস দ্বারা প্রমাণিত। তবে তা দলীলযোগ্য নয়।

(১২) জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, তোফায়েল (রাঃ)-এর গোত্রের জনৈক ব্যক্তি তার সাথে হিজরত করেন এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে সে তার কাঁধের রগ কেটে ফেলে এবং মৃত্যুবরণ করে। তোফায়েল (রাঃ) একদা স্বপ্নে তাকে জিজ্ঞেস করেন, আল্লাহ আপনার সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন? তিনি বললেন, নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট হিজরত করার কারণে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তোফায়েল (রাঃ) বললেন, আপনার দু’হাতের খবর কী? তিনি বললেন, আমাকে বলা হয়েছে, তুমি যে অংশ নিজে নষ্ট করেছ, তা আমি কখনো ঠিক করব না। এ স্বপ্ন তোফায়েল (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট বর্ণনা করলে তিনি তার জন্য দু’হাত তুলে ক্ষমা চাইলেন।[34] হাদীছটি যঈফ।[35]

সুধী পাঠক! উপর্যুক্ত যঈফ হাদীছসমূহের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে বুঝা যায় যে, কোন কোন সময় ছালাতের পর এককভাবে হাত তুলে দু‘আ করা যায়। কিন্তু যঈফ হওয়ার কারণে হাদীছগুলো রাসূল (ছাঃ)-এর কি-না, তা স্পষ্ট নয়। সেকারণ এর উপর আমল করা থেকে বিরত থাকা যরূরী। মাওলানা আব্দুর রহীম বলেন, কেবলমাত্র ছহীহ হাদীছ ব্যতীত অন্য কোন হাদীছ গ্রহণ করা যাবে না। এ কথায় হাদীছের সকল ইমাম একমত ও দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।[36]

সিরিয়ার মুজাদ্দিদ আল্লামা জামালুদ্দীন ক্বাসেমী (রাঃ) বলেন, ইমাম বুখারী, মুসলিম, ইয়াহ্ইয়া, ইবনু মুঈন, ইবনুল আরাবী, ইবনু হাযম ও ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, ফযীলত কিংবা আহকাম কোন ব্যাপারেই যঈফ হাদীছ আমলযোগ্য নয়।[37]

(চলবে)

[1]. সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৫৪৯।

[2]. ত্বাবারানী, আওসাত্ব, হা/৩১৭৮।

[3]. প্রাগুক্ত।

[4]. ইবনুস সুন্নী, হা/১১০।

[5]. সিলসিলা যঈফাহ, হা/১০৫৮।

[6]. নাসাঈ, হা/৯৯২৮।

[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৪৩৯; ছহীহ মুসলিম, হা/২১৯২; মিশকাত, হা/১৫৩২, ১৫৩৩।

[8]. তিরমিযী, হা/২৯২২।

[9]. ইরওয়াউল গালীল, হা/৩৪২; তা‘লীকুর রাগীব, ২/২২৫ পৃঃ; যঈফ জামে‘ ছাগীর, হা/৫৭৩২।

[10]. আবুদাঊদ, হা/১৪০০; মিশকাত, হা/২১৫৩।

[11]. তারগীব, হা/২১০৬।

[12]. ইবনুস সুন্নী, ‘আমালুল ইয়াউম ওয়াল লাইলে’, পৃঃ ৪৯, হাদীছটি যঈফ। হাদীছটির সনদে আব্দুল আযীয ইবনে আব্দুর রহমান ও খায়ীফ নামে দু’জন দুর্বল রাবী রয়েছে।

[13]. ইবনু কাছীর, ২য় খ-, সূরা নিসা ৯৭নং আয়াতের আলোচনা দ্রঃ। হাদীছটি যঈফ, তাহযীব, ৭/৩২৩।

[14]. তাক্বরীব, ২/৩৭।

[15]. তিরমিযী, হা/৩৮৫; মিশকাত, হা/৮০৫।

[16]. তাক্বরীব, ১/৪৫৬।

[17]. মাযমাউয যাওয়ায়েদ, ১/১৬৯।

[18]. তাক্বরীব, ১/১৬৯।

[19]. আবুদাঊদ, হা/১৪৮৫; মিশকাত, হা/২২৪৩।

[20]. আউনুল মা‘বূদ, ১/৩৬০।

[21]. সিলসিলা আহাদীছিছ ছহীহাহ, ২/১৪৬।

[22]. বিস্তারিত দ্রঃ ইরওয়াউল গালীল, ২/১৭৮-১৮২, হা/৪৩৩ ও ৪৩৪-এর আলোচনা, তাহক্বীক্ব মিশকাত, হা/২২৫৫-এর টীকা নং ৪।

[23]. আবুদাঊদ, হা/১৪৯২।

[24]. আউনুল মা‘বূদ, ১/৩৬০; তাক্বরীব, ১/৪৪৪।

[25]. ইবনে আবী শায়বা, ১/৩৩৭।

[26]. মুসলিম, মিশকাত, হা/১৯৮, ১৯৯।

[27]. মাজমাউয যাওয়ায়েদ, ১/১৬৯।

[28]. আহমাদ, তাবারানী, সনদ ছহীহ, ইরওয়াউল গালীল, ২/১৮১, হা/৮৩৮-এর আলোচনা দ্রঃ।

[29]. আদাবুল মুফরাদ, তাহক্বীক্ব হা/৬০৯, পৃঃ ২০৮, ‘দু‘আয় হাত তোলা’ অনুচ্ছেদ।

[30]. আদাবুল মুফরাদ, পৃঃ ২০৮।

[31]. মুস্তাদরাক হাকেম, আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ১/৯০।

[32]. তাক্বরীবুত তাহযীব, পৃঃ ৩১৯, রাবী নং ৩৫৬৩।

[33]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ, ৩য় জিলদ, ৬/৩৩২।

[34]. আদাবুল মুফরাদ, ২/৭০।

[35]. ছহীহ আদাবুল মুফরাদ, হা/৬১৪, পৃঃ ২১০।

[36]. হাদীস সংকলনের ইতিহাস, পৃঃ ৪৪৫।

[37]. ক্বাওয়াইদুত তাওহীদ, পৃঃ ৯৫।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ

Comments